আমি মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পড়লাম। আমার মনে শুধু এটাই আসছিলো যে আমার শাশুড়ীর আত্মা আমাকে মেরে ফেলবে।
কিন্তু কেন?
**
সেদিন আমরা রাজবাড়ী থেকে বাসায় চলে আসলাম। সারাটা পথ আমি কারো সাথে কথা বলিনি। বলার মতো ইচ্ছাশক্তিও নেই। নিজেকে অপয়া মনে হচ্ছিলো। যে আমার যাওয়ার কারণেই মনে হয় হুজুর মারা গিয়েছে।
দিনের আলো নিভে গেছে। আমার মাথাব্যথা উঠায় সন্ধ্যা নামার পরেই আমি শুয়ে পড়লাম। সবুজ বাচ্চাকে নিয়ে পাশের রুমে। গ্রামের রাত মানে আটটার মধ্যে খাওয়াদাওয়া শেষ। সবাই যার যার মতো করে শুয়ে পড়েছে৷ আমি একা এক রুমে, পাশের রুমে সবুজ আর রাফিদ। আর তার পাশের রুমে আমার বাবা৷
আমার ঘুম তখনো গাঢ় হয়নি। দরজা আটকানোর জন্য উঠিনি, তাই সবুজ ওপাশ থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।
আস্তে আস্তে দরজা খোলার শব্দ আমার কানে স্পষ্ট হলো। হালকা বাতাসে দরজা যেমন ক্যাচক্যাচ শব্দ করে খুলে ঠিক তেমনটাই আমি শুনতে পেলাম। তখনো আমার চোখ বন্ধ, দরজাটা একটু খুলে ধুম করে আবার বন্ধ হয়ে গেলো। আমি উঠে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়ে আসলাম। দরজা লাগানোটাই মনে হয় আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো।
বিছানার দিকে তাকাতেই দেখি একটা কালো বিড়াল আমার বিছানায় শুয়ে আছে, আমার দিকে তার অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি আমাকে কামড় দিয়ে বসবে। আমি বুঝে উঠতে পারলাম না বিড়ালটা কোথা থেকে আসলো। আমি বিড়ালটাকে তাড়িয়ে দিতেই সেটি বিছানা থেকে না নেমে যা শুরু করলো তাতে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসলো।
বিড়ালটা শূণ্যে ভাসছে। আর আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত রকমের শব্দ করছে! আমি আমার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করলাম, কিন্তু বরাবরের মতো কোনো শব্দ বের হলো না। মানুষ ভয় পেলে নাকি ভোকাল কর্ড কাজ করে না৷ আমার এক বন্ধু বলতো এইগুলো। আজ দেখছি সেটাই সত্য। একসময় বিড়ালটা আমার উপরে ঝাপিয়ে পড়লো৷ তার আক্রমণের ভাষা বলে দিলো সে শুধু আমার মুখে আর চোখে আক্রমণ করতে চায়৷ প্রচন্ড ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে সবুজ পাশের রুম থেকে বুঝতে পারে কিছু একটা হয়েছে৷ সে ভেতরের দরজা খুলে আমার রুমে চলে আসে।
সবুজ রুমে ঢোকার সাথে সাথে বিড়ালটা চোখের নিমিষেই গায়েব হয়ে যায়।
সবকিছুই ঠিক ছিলো। একটা বিড়াল রুমে ঢুকে ভয় পেয়ে আক্রমণ করে বসতেই পারে। কিন্তু জলজ্যান্ত একটা বিড়াল চোখের পলকে গায়েব হয়ে যায় কিভাবে?
সবুজ আসার সাথে সাথে আমি তার পিছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলাম।
আমার কাছ থেকে সবকিছু শোনার পরে তখনই সিদ্ধান্ত হলো আমাদের মসজিদের হুজুরের কাছে যাওয়ার। আমার বাবাকে ডাকার জন্য রুমের বাইরে পা দিতেই আমরা দুজনে যা দেখলাম তাতে অবাক হওয়ার মাত্রাটা আরো বেড়ে গেলো। দরজার বাইরে একটা বৃত্ত আঁকা, তারমধ্যে একটা বিড়ালের ছবি, আর ছবিটি উল্টানোর পরেই দেখলাম আমার নাম লেখা এবং রক্ত দিয়ে ক্রস চিহ্ন আঁকা।
আমি ভয়ে জোরে জোরে কান্না করতে লাগলাম। আমার বাবা কান্নার শব্দ শুনেই উঠে আসলো।
বিড়ালের ছবি, বৃত্ত, আমার নামে ক্রসচিহ্ন। সবকিছু কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছিলো আমার কাছে। আমি জীবনেও কোনোদিন এমন ঘটনার স্বাক্ষী হইনি।
মসজিদের হুজুরের কাছে যেতেই হুজুর আমাকে না দেখেই বললেন,
- এ তো বড় সমস্যায় আছে।।
আমরা সবাই হা করে তার দিকে চেয়ে রইলাম। তিনি সব ক্লিয়ার করে বললেন,
- সবুজ মিয়া। আপনার বউয়ের উপর বান (ব্ল্যাক ম্যাজিক) মেরেছে কেউ একজন। এই বান কে মেরেছে, কেন মেরেছে যদি সেটা খুঁজে বের করা না যায় তাহলে আপনার বউয়ের খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। এমনকি মৃত্যুও পর্যন্ত হতে পারে। তবে বান মারার প্রভাব কিছুদিনের মধ্যে খুব ভয়ংকর আকারে প্রকাশ করবে।
আমি আরেকটা তথ্য দিতে পারি, বানটা মেরেছে আপনাদের কাছের কেউ।
- হুজুর আপনি কি আর কিছু করতে পারেন না?
- আমার আর কিছু করার ক্ষমতা নেই। তবে একজন আছে, তার বাড়ি পদ্মার কাছে সেনগ্রামে। কিন্তু হুজুর তো ইন্ডিয়াতে। ২০ দিন পরে আসবে৷ উনার কাছে গেলে আর আল্লাহর মর্জি থাকলে আপনাদের সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে। কিন্তু ২০ দিন অনেক সময়। এর মধ্যে আপনার বউয়ের বিরাট ক্ষতি হতে পারে। আপনি সবসময় তাকে চোখে চোখে রাখবেন।
নিজের ক্ষতির কথা অন্যের মুখ থেকে এভাবে শুনে নিজের কাছেই খুব অবাক লাগছিলো। কার কি এমন ক্ষতি করেছি যে সে আমার পিছনে লেগেছে। এ বাড়িতে এসেও তো কারো সাথে ঝগড়া করিনি। তাহলে কে?
হুজুরে সেদিন পানি পড়া আর কিছু ঝাঁড়ফুক করে দিলো।
সেই রাতে আর ঘুম হলো না। একটা অজানা হয় আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে লাগলো।
দুইদিন বেশ ভালোই কাটলো, এর মধ্যে আমার অসুস্থতার কথা শুনে আমার মা, ছোটবোন আর সবুজের কিছু আত্মীয় আসলো আমাকে দেখতে। তাদের সবাইকে একসাথে দেখে আমার মন ভালো হয়ে গেলো। মনে হলো আমার কিছুই হয়নি। যদিও হুজুর আমাদের যা বলেছে আমরা তা কারো কাছে বলিনি৷ সবুজ এটা শেয়ার করতে নিষেধ করেছে। কারণ ঘটনা যদি সত্যি হয় তাহলে আমরা যে বিষয়টা জেনে গেছি এটার জন্য ব্ল্যাক ম্যাজিককারী আরো সতর্ক হয়ে অন্য চাল চালতে পারে। তাই আমার মায়ের কাছেও এ ঘটনা বলিনি।
দিন যায় রাত আসে, কিন্তু সেই রাতই আমার কাছে শেষরাত মনে হয়। শুধু এটুকু মনে হয় কেউ একজন আমাকে মেরে ফেলবে। আমার মাথাব্যথা প্রকট আকার ধারণ করে। মাথাটাকে আমি সোজা করে রাখতে পারতাম না। এমন মাথাব্যথা আমি কোনো সময়ই অনুভব করিনি। যখন মাথাব্যথা উঠতো তখন মাথাকে ছিড়ে ফেলতে মনে চাইতো।
রাতে খাওয়ার পরে সবুজের অভ্যাস অনুযায়ী প্রায়ই সে তাদের পুকুরের পারে যায়। রাফিদ ঘুমিয়ে যাওয়ায় একা একা ভালো লাগছিলো না। তাই মনে করলাম যাই, সবুজের সাথে একটু রাত উপভোগ করে আসি। উঠোন পার হওয়ার পরেই দেখি সবুজ পুকুর পাড়ে বসে আছে। আমি দ্রুতই সেখানে চলে গেলাম। আমি যত দ্রুত সবুজের কাছে যাই, সবুজ ততটাই দ্রুত সামনে এগোতে থাকে। হঠাৎ কারো স্পর্শে আমি ঘাড় ঘুরাতেই কেউ একজন আমার গলা টিপে ধরে। অন্ধকারে মুখটা স্পষ্ট বোঝা না গেলেও আমি অনুভবে টের পেলাম আমার শাশুড়ির অবয়ব সেটা। তারপাশে একটা বিড়াল বাঘের মতো গর্জন করছে।
আমার গোঙানির শব্দে পাশের বাড়ির ভাবি কৌতুহলবশত পুকুরপাড়ে এসে দেখে আমি শূণ্যে ভেসে আমার সামনে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করতেছি। সে চিৎকার করতেই সবুজ আর কয়েকজন সেখানে দৌঁড়ে যায়। মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে অবয়বটা আমাজে ছেড়ে দেয়৷ আমি দুই হাত উপর থেকে মাটিতে পড়ে যাই।
আমার দম প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছিলো৷ আরেকটু হলেই মনে হয় আমি মরে যেতাম। কিন্তু এভাবে আর কত দিন?
আমাকে সবাই মিলে ধরে রুমে নিয়ে যাচ্ছে, আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম সেই বিড়ালটা আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুতভাবে শব্দ করতে করতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। সবার সামনেই ওই বিড়ালটা। আমি সবুজকে বললাম,
- ওই বিড়ালটাই আমাকে সেদিন মারতে এসেছিলো। সবুজ ওই দেখো সেই বিড়ালটা।
সবুজ ওদিকে তাকিয়ে আমাকে বললো,
- আরে ওখানে বিড়াল নেই। তুমি ভুল দেখতেছো, বিড়াল আসবে কোথা থেকে। কিন্তু আমি তখনো স্পষ্ট বিড়ালটাকে দেখতে পেলাম।
বিড়ালটা সবার আগে রুমে প্রবেশ করলো। আমি দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়াতেই কেন জানি আমার মাথা ব্যথা প্রকট আকার ধারণ করলো।
মাথার যন্ত্রণায় আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
ঘুম ভাঙলো মুখে পানির ছিটাই। সবুজ আমার ঘুম ভাঙিয়ে আমাকে বললো,
- উঠে রেডি হও। সেই হুজুর গতকাল এসেছে। আজকে তার সাথে দেখা করতে যাবো। তাকে সবকিছু খুকে বলবা। ইনশাআল্লাহ তাহলে ভালো হয়ে যাবে।
আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে রেডি হচ্ছি। এমন সময় আমাদের বাড়িতে সবুজের মামাতো বোনের আগমন। যার সাথে সবুজের বিয়ে ঠিক হয়েছিলো।
সে চিল্লাইয়া বলতে লাগলো,
- ভাইয়া, আমি আজ স্বপ্নে দেখেছি তোদের খুব খারাপ কিছু হবে। তোরা প্লিজ বাড়ির বাইরে যাস না। স্বপ্নে দেখেছি তোরা এক্সিডেন্ট করেছিস। কি একটা অবস্থা!
আমি তোদের আজ বাড়ির বাইরে যেতে দিবোনা। ভোর রাতের স্বপ্ন সত্যি হবে।
- আরেহ, আজ তোর ভাবিকে ওই হুজুরের কাছে দেখাতে হবে। তোর ভাবির কেমন সমস্যা হচ্ছে তুই দেখছিস না?
- ভাবিকে কালকেও দেখাতে পারবা। আজ যাওয়ার দরকার নাই।
সবুজ আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
- এতো করে বলছে। তাহলে কাল যাই। সত্যি যদি কোনো অঘটন ঘটে, তাহলে তো খারাপই হবে।
তারচেয়ে বরং আগামীকাল যাই।
আমি কিছু না বলে শুধু মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
সেদিন রাতটা আমার জীবনের সবচেয়ে অভিশপ্ত রাত ছিলো।
বিকেল থেকে শুরু হয় আমার প্রচন্ড মাথা ব্যথা, একপর্যায়ে রক্তবমি। চোখ বন্ধ করলে আমার শাশুড়ি এসে আমাকে গলা টিপে ধরে আর বিড়ালটা হিংস্র রূপ প্রদর্শন করে!
© bnbooks.blogspot.com
