প্রেতাত্মা
লেখক: রাশেদ হাসান
পর্ব ১
আমি কোনো কথা বা শব্দ করতে পারছিলাম না কারণ প্রচন্ড চাপ আমার গলায় পড়তেছিলো।
আমার হাত পায়ের ছুটোছুটিতে সবুজের ঘুম ভেঙে গেলে সে আমাকে ধাক্কা দিয়ে উঠিয়ে দেয়।
আমি শোয়া থেকে উঠে বসে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকি। সবুজ আমাকে পানি দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
- দুঃস্বপ্ন দেখেছো! সমস্যা নাই, পানি খাও ঠিক হয়ে যাবা।
আমি কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকি। কারণ একটু আগে আমার সাথে যা হয়েছে এটা সবুজের সাথে শেয়ার করলে সে আমাকে বারবার একই কথা বলে। সেটা হলো দুঃস্বপ্ন।
অবশ্য আজ এইটা প্রথম না। আমি প্রায়ই এরকম ঘটনার স্বাক্ষী হই। কেন, কি কারণে আমার শাশুড়ী আমাকে গলা টিপে মারতে আসে সেটা আমি জানিনা। আর কিভাবে সম্ভব সেটাও বুঝিনা। কারণ আমার শাশুড়ী আরো এক বছর আগে মারা গিয়েছে।
সবাই বলে আমাদের উপর অভিমান করে মারা গিয়েছে।
সেদিন প্রচন্ড রোদের মধ্যে আমি কাজ করছি উঠোনে। রুমের আমার ছেলে রাফিদ শোয়ানো। হঠাৎ আমার নজর রুমে পড়তেই দেখি আমার শাশুড়ী আমার ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি চিৎকার উঠার সাথে সাথে অবয়বটি গায়েব হয়ে যায়।
সবুজ আর আমি আমাদের বাবা মায়ের অমতে বিয়ে করি আরো দুই বছর আগে। আমাদের বিয়েটা কোনো পরিবারই মেনে নেয় নি। আমার শশুড়বাড়ি থেকে আরো মেনে না নেওয়ার কারণ হলো আমার শাশুড়ী সবুজের জন্য তার ভাইয়ের মেয়েকে পছন্দ করে রেখেছিলো।
কিন্তু আমরা সেই আশায় গুড়েবালি ঢেলে পালিয়ে বিয়ে করি।
বিয়ের ছয়মাসের মাথায় সবুজ একদিন আমাকে নিয়ে তার বাসায় হাজির হয়। প্রথমে তার মা বাবা আমাদের ঘরে ঢুকতে না দিলেও পরে ঢুকতে দেয়। কিন্তু আমাকে কেউই মেনে নেয়নি৷ নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হতো সবুজের পরিবারে আমাকে নিয়ে।
এমন একটা দিন যেতো না যেদিন আমার শাশুড়ী আমাকে অপমান করতো না। নানা কথা আমাকে শোনাতো। এরমাঝে একদিন আমার সাথে বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে আমার শাশুড়ী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে।
** খাটে নখের আঁচর দেওয়ার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। স্বপষ্ট শুনতে পাচ্ছি কেউ একজন নখ বা কোনো কিছু দিয়ে খাটে আঁচর কাটছে। আমার অভ্যাস অনুযায়ী গায়ে একটা কাঁথা জড়িয়ে শুয়ে আছি। পুরো বাড়িতে মানুষ বলতে আমি আর আমার ছেলে। তাছাড়া কেউ নেই। সবুজ ব্যবসায়ীক কাজে কুষ্টিয়াতে গিয়েছে। ফিরতে তার আরো দুইদিন লাগবে।
কাঁথাটা উঠিয়ে বাচ্চাকে কোলের মধ্যে নিয়ে ভালো করে মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলাম উদ্দেশ্য বাইরে যা হওয়ার হোক, আমি কাঁথা থেকে মাথা বের করবো না।
মিনিট খানেক যাওয়ার পরে নিস্তব্ধতার সৃষ্টি হলো। চারিদিক চুপ, হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে গেলো। পরিবেশটা কেমন যেন ভারী হয়ে যাচ্ছে যা আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম।
হঠাৎ আমার কাঁথা আমার মুখের উপর থেকে সরে যেতে থাকলো। আমি কাঁথাটা শক্ত করে ধরে রাখলাম। কিন্তু পারলাম না, হুট করেই সেটা সরে গেলো।
আমি তখনো চোখ বন্ধ করে আছি। আমার মুখের উপর আমি নিঃশ্বাস ফেলানোর শব্দ অনুভব করলাম। হঠাৎ করেই আমি চোখ খুলে ফেলি। একজোড়া লাল টুকটুকে চোখ আমার মুখ থেকে ইঞ্চি দুয়েক উপরে। আমি আমার সর্ব শক্তি দিয়ে চিৎকার করলাম। কিন্তু কেউ একজন আমার মুখ চেপে ধরলো।
ছুটোছুটির এক পর্যায়ে আমার মুখ থেকে হাত সরিয়ে কেউ একজন বিছানা থেকে নেমে পরে।
ভালোভাবে তাকাতেই দেখি সিলিংয়ে কেউ একজন ঝুলে আছে। আমি হাতরে মোবাইলটা হাতে নিলাম। মোবাইলে আলো জ্বালাতেই দেখি রাত পৌঁনে তিনটা বাজে।
আমি সবুজকে সাথে সাথে কল দিলাম। প্রচন্ড বিরক্তিকর ভাব নিয়ে কল ধরতেই আমাকে বললো,
- এতো রাতে কল দিয়েছো কেন?
- সবুজ আমাকে কেউ একজন মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। আমি মরে যাবো সবুজ।
- তুমি আজকেও সেই দুঃস্বপ্ন দেখেছো তাইনা।
ঘুমিয়ে যাও। বেশি ভয় পেলে আয়তুল কুরসী পড়ে ঘুমাও। সারাদিন কাজ করে অনেক ক্লান্ত আমি। ঘুমাও সোনা।
সবুজ ফোন রেখে দিলে আমিও নিজেকে স্বান্তনা দিলাম এগুলো আমার মনের ভুল। কিন্তু পরক্ষণেই যা দেখলাম তাতে আমার গায়ের লোম সব দাঁড়িয়ে গেলো।
আমি আমার শাশুড়ীর রুমে শুয়ে আছি। যেই রুমের দরজা শাশুড়ী মারা যাওয়ার পরে আর কেউ খোলেনি।
কিন্তু কিভাবে? রুমের দরজা খুলে কিভাবে আমি এখানে আসলাম। রুমের চাবিও তো আমার কাছে নেই। তাহলে কিভাবে সম্ভব?
মাকড়সার জাল আর ধুলোতে পুরো রুমের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে আছে। আমি কোনো রকমে রুম থেকে বের হয়ে দরজা লাগিয়ে দিলাম।
সবুজকে না বলে পরেরদিন আমি আমার বাবার বাড়ি চলে গেলাম। আমার বাবাকে সবকিছু খুলে বললাম। বাবা আমার কথা শুনে খুব অবাক হলো সাথে আমাকে প্রচুর বকা দিলো এই বলে যে কেন আমি তাকে আগে এসব জানাইনি।
সিদ্ধান্ত হলো আমরা একটা বুজুর্গ লোকের কাছে যাবো। আমাদের সব কাহিনী তার কাছে বললে সে কিছু একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
কিন্তু সবুজকে না বলে এই কাজ করলে সে খুব রাগ করবে। তাই আমি সবুজকে ফোন দিয়ে আমাদের বাড়িতে আসতে বলি।
একদিন পরে সবুজ বাড়িতে আসলে আমার বাবা মা সবুজকে সব বলে। সবুজ আমার মুখের দিকে চেয়ে রাজি হয়ে যায়।
***
সন্ধ্যার এই সময়টাকে কালি সন্ধ্যা বলে। একদম ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢেকে যাবে সবকিছু, এমন একটা পরিবেশ। আমি, সবুজ আর আমার বাবা রাজবাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি৷ সোনাপুরে একটা হুজুর থাকে, অনেক বুজুর্গ। তার কাছে গেলেই আমার সমস্যা সমাধান হবে।
মেইন রাস্তা থেকে নেমে একটা মাটির রাস্তা দিয়ে তিনজনে হেঁটে যাচ্ছি। ততক্ষণে রাত ৮ টা বেজে গেছে, গ্রামে রাত ৮ টা মানে অনেককিছু। কিছুদূর যাওয়ার পরে আমরা একটা লোককে দেখলাম যিনি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আব্বু গিয়ে লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলো,
- আসসালামু আলাইকুম ভাইজান।
লোকটা গম্ভীরভাবে উত্তর দিয়ে বললো,
- হুম, বলেন!
- আচ্ছা ভাই, সালাউদ্দিন হুজুরের বাড়ি কোনদিকে বলতে পারেন? রাতের বেলা তো, তাই চিনতে পারতেছি না!
-আপনি আমার সাথে আসেন। পথ দেখিয়ে দিচ্ছি।
আমরা কোনো কথা না বলে লোকটার পিছু নিলাম৷ তাকে অনুসরণ করে হাঁটতে লাগলাম। একটা বাগানের মধ্য দিয়ে হাঁটছি আমরা। হঠাৎ কেউ একজন আমার পা আঁকড়ে ধরলো। আমি পা টাকে জোরে হ্যাচকা টান দিয়ে ছাড়িয়ে নিলাম। প্রথমে ভাবলাম হয়তোবা কোনো গাছের শেঁকড়ে পা বেঁধেছে।
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আবার হওয়ায় আমি জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। সবুজ এবং আমার বাবা দুজনেই পেছনে তাকিয়ে দেখে আমি মাটিতে বসে আছি। মোবাইলের ফ্ল্যাশ আমার দিকে ধরতেই আমি দেখি মাটির মধ্যে থেকে একটা হাত বেরিয়ে আছে যা আমার পা ধরে আছে।
আমি ভয় চিৎকার এবং কান্না করতে থাকি। তারা দুজনে আমাকে অভয় দিতে থাকে। সবুজ একটা লাঠি নিয়ে হাতটাতে আঘাত করলে সেটি আমার পা ছেড়ে দেয়।
পরক্ষণেই সেই হাতটি গায়েব হয়ে যায়। আমার বাবা জোরে জোরে সেই লোকটার কাছে সাহায্য চাইতে থাকে। কিন্তু সেই লোক কেন, লোকটার ছায়াও আমরা দেখতে পাইনা।
আমরা সবাই আবার হাঁটতে থাকি। কিছুদূর যাওয়ার পরে হঠাৎ কিছু একটার সাথে সবার সামনে থাকা সবুজ ধাক্কা খায়। মোবাইলের ফ্ল্যাশটা ধরে সে দেখতে চায় কিসের সঙ্গে ধাক্কা খেলো। আলো ধরার পরে আমরা যা দেখলাম তাতে সবার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ আগে যে ব্যক্তি আমাদের পথ দেখাচ্ছিলো সে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুঁলে আছে।
আমরা কোথায় আছি, কিভাবে আছি তা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কারণ আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। ভয়ে আমি কান্না করতে থাকলাম। আমার জীবনে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে তা কোনোদিন আমি কল্পনাও করতে পারিনি। নিজেকে কেন জানি বারবার দোষী মনে হচ্ছিলো। হয়তোবা আমাদের কারণে শাশুড়ী মারা গিয়েছে মনে অনেক কষ্ট নিয়ে। যার ফল আমরা সবাই ভোগ করতেছি।
যেই বাগানটাতে আমরা ঢুকেছি। সেই বাগানের পথ কোনোমতেই ফুরাচ্ছে না। মনে হচ্ছে সারারাত হাঁটলেও এ পথ ফুরাবে না। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে একসময় আমরা ক্লান্ত হয়ে যাই।
রাত কিভাবে ফুরিয়ে যায় জানিনা, ফজরের আজান হওয়ার সাথে সাথে আমরা আমাদের পথ খুঁজতে থাকি।
**
সোনাপুরে ঢুকার পরে এলাকাটাকে কেমন যেন নিস্তব্ধ মনে হতে লাগলো। চারিপাশ কেমন যেন চুপচাপ। এলাকায় তেমন কাউকে দেখতেও পারছি না। স্থানীয় একজনকে জিজ্ঞাসা করে সালাউদ্দিন হুজুরের বাড়ির পথে হাঁটতে লাগলাম। একটা সময় হুজুরের বাড়িতে ঢোকার পথে প্রচুর মানুষ আর কান্নার শব্দ শুনে বুঝতে বাকি রইলো না এ বাড়িতে কেউ একজন মারা গেছে।
কে মারা গিয়েছে তা দেখার জন্য আমার বাবা ভেতরে গেলো। মিনিট খানেক পরে আমাদের কাছে এসে বললো,
- মা রে তোর জন্য কিছুই করতে পারলাম না। হুজুর মারা গিয়েছে!
আমি যতোটা না কষ্ট পেলাম তারচেয়ে বেশি অবাক হয়ে গেলাম।
চলবে……………..…....…
© bnbooks.blogspot.com
