মাথাব্যথা এতোটাই বেশি ছিলো যে উঠার মতো শক্তি বা সামর্থ্য কোনোটাই হচ্ছিলো না, তবুও আমি একা একা গোয়ালঘরের দিকে যাত্রা শুরু করি।
যেটা আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো। বাইরে গিয়ে দেখি গোয়ালঘরের দরজা খোলা, আমি ভেতরে টর্চের আলো ধরতেই কেউ একজন আমার মুখের উপর একটা পর্দা ফেলে দিয়ে আমার হাত পা বেঁধে ফেলে।
আমার মুখ চেপে ধরে প্রচন্ড মারধর করতে থাকে আমাকে, আমার মুখ চেপে ধরে রাখায় আমি না পারছিলাম কান্না করতে না চিৎকার করতে। কিছুক্ষণ মারার পরে সে টান দিয়ে আমার মাথার কিছু চুল ছিঁড়ে নেয় এবং গোঙাতে গোঙাতে বলে,
- এই কুত্তারবাচ্চা তো খালি খালি মরবেনা মনে হয়, আমিই আগে মেরে ফেলবো।
রাতে ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজন পড়লে সবুজ বাইরে এসে দেখে আমি ওভাবে পড়ে আছি গোয়ালঘরের সামনে।
কিছুদিন যাবত নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। না আছে আমার কোনো ক্ষমতা, না আছে অন্যকিছু।
পরেরদিন সকাল থেকে আসল খেলা শুরু হলো। আমি মাথায় হাত দিলেই আমার চুলগুলো হাতের সাথে উঠে আসা শুরু করলো সাথে বোনাস হিসেবে মাথাব্যথা।
প্রচন্ড মাথাব্যথা আর চুল পড়ার কারণে একদিনেই আমার মাথার চুল অর্ধেক হয়ে গেলো।
বিকেল বেলা সবুজ এসে বললো,
- এই তাড়াতাড়ি রেডি হও তো। হুজুরের বাড়ি যাবো।
- হুজুরের বাড়ি গেলেই কি আমাকে বাঁচাতে পারবে?
-বেশি কথা বলো না তো। রেডি হও।
সবুজের সাথে রেডি হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।
হুজুরের বাড়িতে যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। ভদ্রলোক মাগরিবের নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়েছে।
আমাদের তার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে৷ আমাদের আগে আরো দুজন এসে বসে আছে।
মিনিট বিশেক পরে হুজুর আসলো। ভদ্রলোক অনেকটা বয়স্ক, ঢিলেঢালা পাঞ্জাবি পড়ে আছে।
সিরিয়ালে যখন আমার ডাক আসলো তখন আমি ও সবুজ ভেতরে গেলাম।
আমাকে দেখে, সবকিছু শুনে কিসব করে আমাদের বললো,
-সবুজ আপনার স্ত্রীর উপরে বান মেরেছে আপনাদের খুব কাছের একজন। আমি নাম বলতেছিনা এখন। কিন্তু যে এই কাজটি করেছে সে আপনাদের খুবই কাছের লোক।
আপনাদের ঘর থেকে সেই লোকটি অনেক কিছুই সংগ্রহ করেছে। আপনার স্ত্রীর কাপড়ের অংশ, চুল, তার ব্যবহৃত মাথার তেল আরো অনেক খুঁটিনাটি জিনিস।
খুব শক্তিশালী একটা জ্বীনের মাধ্যমে এই বানটি মারা হয়েছে। আপনাদের রুমের আশেপাশে এই বান মারার জিনিসপত্র আর যেই জিনিসটাকে সম্বল করে বান মারা হয়েছে সেটি আছে।
এগুলো খুঁজে বের করতে হলে আমাকে আপনাদের বাড়িতে যেতে হবে। আপাতত আমার সাধ্যমতো আমি সবকিছু করে দিচ্ছি। বাকিটা আল্লাহ ভরসা, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনিই পারেন আপনাদের রক্ষা করতে।
তবে আরেকটা কথা, আপনার স্ত্রীকে চোখে চোখে রাখবেন। যে কোনো সময় যেকোনো ধরণের অঘটন ঘটে যেতে পারে।
হুজুরের কথাগুলো শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কান্না করা তো দূরের কথা আমার বরং হাসি পাচ্ছিলো। আমি কি কাউকে কিছু করেছি? না কারো কোনো ক্ষতি করেছি বুঝতেছিলাম না।
বাড়ি ফেরার পথে আমি কোনো কথা বললাম না সবুজের সাথে! সারা পথ চুপ করে রইলাম।
বাড়ি ফিরে দেখি বারান্দার এক কর্ণারে বসে আমার বাবা আর আমার শশুড় গল্প করছে। আমার শশুড় অনেকদিন পরে আমাদের বাড়িতে এসেছে। আমার শাশুড়ি মারা যাবার পরে আমাদের বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলো আর কখনো আসেনি। আমার বাচ্চা যখন হয়, তখন হাসপাতালে গিয়ে তার নাতিকে কোলে নিয়ে পাচশো টাকার একটা নোট গুঁযে তার দায়িত্ব পালন করে চলে এসেছিলো।
দুজনকে পানের পাতিল এগিয়ে দিলো সবুজের মামাতো বোন মুক্তা। আমাকে দেখেই আমার বাবা বলে উঠলো,
- ওই যে ওরা চলে এসেছে।
আমার শশুড় তখনো চুপ করে বসে আছে। একটু পরে তার সমস্ত অভিমান ছেড়ে আমার সামনে এসে কান্না করতে করতে বললো,
- মা, তোমার কি হয়েছে? আমাকে আগে জানাও নাই কেন? আমি কি তোমাদের পর?
নানা কথা আর প্রশ্ন করতে লাগলো আমাকে। আমি চুপচাপ তার প্রশ্ন শুনে গেলাম।
আমার মনেও অনেক অভিমান জমে আছে। আমি কি চাইলেই সেগুলো প্রকাশ করতে পারবো? তারচেয়ে বরং চুপচাপ শুনি।
মুক্তা এসে আমাকে বললো,
- ভাবি চলেন রুমে। আমি রান্না করে রেখেছি। দুজন ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নেন।
এই সবুজ ভাইয়া, দুজনে গোসল করে আসো। ভালো হবে।
সবকিছু করে রুমে আসার পরে বিছানায় গিয়ে কিছু অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করলাম। মনে হচ্ছে কেউ একজন আমাদের রুমে ঢুকে বিছানাপত্র উল্টেপাল্টে দেখেছে। দরজার সামনের মাটি কিছুটা আলগা মনে হলো। সবমিলিয়ে আমার কাছেই মনে হতে লাগলো আমাকে মারার জন্য কোমরের কাপড় আঁটসাঁট করে বেঁধেছে কেউ!
কিন্তু কে?
****
চোখ খুলে দেখি আমি আমাদের এলাকার কবরস্থানের নীচের দিকে। আমার বুক পর্যন্ত মাটির নীচে।
আমি রাতের ঘটনা মনে করতে লাগলাম আমার সাথে কি হয়েছিলো? কেনই বা আমি এখানে!
রাত তখন আনুমানিক সাড়ে বারোটা। ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য বের হয়েছি। আমার অভ্যাস অনুযায়ী চুল ছেড়ে শুয়ে ছিলাম সেদিন। ওয়াশরুমে যাওয়ার সময়ও চুল বেঁধে নিইনি।
বারান্দা থেকে পা ফেলাতেই কেউ একজন আমার চুলের মুঠি ধরে আমাকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে শূন্যে নিয়ে গেলো। চুল ধরার সাথে সাথে আমার মাথাব্যথা প্রচন্ড রূপ ধারণ করলো। আমাকে শূণ্যে দুই থেকে তিনবার ঘুরিয়ে আমাকে নিয়ে গেলো গ্রামের কবরস্থানের নীচে। ঢালু ধানী জমিতে আমাকে আছাড় দিয়ে ফেলা হলো। আমার নড়াচড়া করার মতো শক্তি ছিলো না। আমাকে আবারো আছাড় দেওয়া শুরু হলো যার ফলে আমি ক্রমস মাটির ভেতরে দেবে যাচ্ছিলাম।
জানিনা কেন কিন্তু একপর্যায়ে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।
সকালে ধানের জমি দেখতে এসে আমাকে দেখে গ্রামের একজন। আমাকে চিনতে পেরে সবুজের কাছে ফোন দেয়।
হাসপাতালে যাওয়ার পরে আমাকে ভর্তি করানো হয়৷ এক্সরেতে দেখা যায় আমার মেরুদণ্ডে আঘাত লেগেছে। আমাকে বেড রেস্টে থাকতে হবে।
আমার জীবনটাকে খুব তুচ্ছ মনে হতে লাগলো। সবুজ আমার সামনেই হুজুরকে ফোন দিলো।
তাদের কথোপকথনে বুঝলাম আমি সুস্থ হলে হুজুরকে ফোন দিতে বললো।
একের পর এক অদ্ভুত সব কান্ড আমার সাথে ঘটতে লাগলো। আমি অতীতের কিছু কথা মনে করতে থাকলাম।
এই সংসারে আমার আপন বলতে সবুজ, রাফিদ, আর আমার শশুড়। মুক্তা আমাকে তার বোনের মতো দেখে আর মুক্তার মা মাঝেমাঝে আসে আমাদের বাড়িতে।
আমার শাশুড়ী মারা যাওয়ার পরে আমাকে অভিশাপ দিয়েছিলো মুক্তার মা।
বাড়ি ভরা মানুষের সামনে আমাকে মন ভরে অভিশাপ আর গালমন্দ করেছিলো। এরপর থেকে আর আসে না আমাদের বাড়িতে।
**
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছি। হঠাৎ রুমে আমার শাশুড়ীর আগমন। হাতে টিফিন বক্স আর ফলমূলের প্যাকেট নিয়ে আমার কাছে এসে বললো,
- এই উঠো বউমা। এগুলো খেয়ে নাও। তোমার শরীর খুব দূর্বল।
আমাকে খাওয়ানোর জন্য টিফিন বক্স খুকে তারমধ্যে থেকে একটা ছুরি বের করে আমাকে মারতে গেলো।
আমি খুব জোরে চিৎকার করে উঠলাম।
আমার চিৎকার শুনে সবুজ লাফিয়ে উঠে বসলো।
আমাকে ধাক্কা দিয়ে বললো,
-এই কি হয়েছে তোমার?
চিৎকার করো কেন?
আমি চোখ খুলে বুঝলাম এটা আমার দুঃস্বপ্ন।
হাসপাতাল থেকে আমাকে ছাড়া হলো তিনদিন পর। যদিও কোমরটাকে নড়াতে পারিনা ঠিক মতো। তবুও হাসপাতাল ছেড়ে চলে আসলাম। কেমন জানি দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।
বাড়িতে ফেরার পরে সবুজ হুজুরকে ফোন দিলো। হুজুর বললো আজ সন্ধ্যার মধ্যে আমাদের বাড়িতে সে আসবে।
আমার শরীর খারাপ দেখে আমার মা আর বোনে এসেছে আমার সাথে। তারাই বাড়ির সমস্ত কিছু করছে। সাথে মুক্তা তাদের সাহায্য করছে।
হুজুর আসলো আছরের নামাজের পরে। তার সাথে দুজন লোক এসেছে। আমাদের বাড়ির চারপাশটা তারা খুব ভালোভাবে লক্ষ করলো, ঘুরে দেখলো।
আমাদের সবাইকে একসাথে হতে বলে হুজুর বললো,
- আমাকে একটা জায়নামাজের ব্যবস্থা করে দিন।
সবুজ জায়নামাজ এনে দিলো।
হুজুরদের আসা দেখে আশেপাশের অনেকে জড়ো হয়েছে। সবাই খুব উচ্ছ্বাস নিয়ে কি ঘটছে দেখছে। আমি অসহায়ের মতো তাদের চাহনি দেখছি।
হঠাৎ হুজুর বললো,
- সবুজ আপনাদের শোবার ঘরে আমাকে নিয়ে চলেন।
সবুজ কোনো কথা না বলে তাকে নিয়ে গেলো। আমি বারান্দা থেকে দেখলাম হুজুর আমার বিছানার নীচ থেকে একটা পঁচা টাকি মাছ বের করে নিয়ে আসলো।
কিন্তু তার কোনো গন্ধ নেই।
আমার সামনে ধরে বললো,
- এইটা হলো আপনার মাথাব্যথার কারণ!
সবুজ, আরো অনেক জিনিস আছে আপনাদের বাড়ির আশেপাশে। যেই জ্বীন এই বান মারার সাথে জড়িত সে খুব শক্তিশালী জ্বীন। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি জানার আর কি কোথায় আছে। কিন্তু তার সাথে আমার জ্বীনগুলো শক্তিতে, বুদ্ধিতে পারছেনা।
তবে খুব শীঘ্রই সমাধান পাবেন ইনশাল্লাহ। একটা অনুরোধ আপনারা ছাড়া আপনাদের রুমে যেন কেউ না ঢোকে এদিকে নজর রাখবেন।
চলবে…………
© bnbooks.blogspot.com
