রুমের চারিদিক সে ঘুরতো। আমি সরাসরি মুখে না বলতে পারতাম না। তাই আমি সবুজের কাছে কথাটা শেয়ার করলাম।
- সবুজ, দেখো হুজুর রুমে কাউকে ঢুকতে নিষেধ করছে। যেহেতু এই কাজটা আমাদের কেউই একজন করেছে। আমি মুক্তাকে সন্দেহ করছি না। কিন্তু ও আমার রুমে কেন জানি বেশি বেশি আসছে। ওকে আসতে নিষেধ করে দিও।
- তুমি ওকে সন্দেহ করছো?
- আমি আগেই বলেছি সন্দেহ না। শুধুমাত্র হুজুরের কথার প্রেক্ষিতে বলতেছি।
- আচ্ছা আমি বারণ করে দিবো।
সবুজ মুক্তাকে গিয়ে নিষেধ করার পরে মুক্তা রাগে গদগদ করতে করতে বাড়ি চলে গেলো।
সেদিন বিকেলে হুজুরের আসার কথা। আজকে এসে সে সব সমস্যার সমাধান করে দিবে। সেসবের প্রস্তুতি চলছে।
যথারীতি হুজুর ও তার সাথে কয়েকজন আসলো। তাদের কাজ শুরু করতে করতে এশার নামাজের পরে তারা শুরু করলো।
হঠাৎ আমার শশুড়ের চিৎকারে সবকিছু পন্ড হয়ে গেলো। আমাদের পুকুরের সাইড থেকে শব্দটা আসলো। সবাই যার যার কাজ ফেলিয়ে রেখে দৌঁড়ে পুকুর পাড়ে গেলাম। পুকুরপাড়ে যা ঘটেছে তা দেখে আমি তব্দা খেয়ে গেলাম। এখানে এসে এমন দৃশ্যের সাক্ষী হতে হবে যা জীবনেও ভাবিনি।
আমার শশুড়কে হত্যা করে তাকে গাছের ডালে ঝুঁলিয়ে রাখা হয়েছে। কিসের ভেতর কি হচ্ছে বুঝতে পারতেছিলাম না।
সেদিনের মতো সবকিছু ফেলে রেখে সবাই শশুড়কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু লাভ আর হলো না।
দাফন কাফন সম্পূর্ণ করা হলো। এমনিতেই বাড়িটা সুনসান, শশুড়ের বিয়োগে কেমন যেন ভুতুড়ে মনে হতে লাগলো আমার কাছে।
অনেক বলে হুজুরকে দুইদিন পরেই নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হলো৷ যেদিন হুজুর আসবে সেদিন সকাল থেকে আমার প্রচন্ড মাথাব্যথা শুরু হলো। আর হুট করেই শুরু হলো সেই আগের মতো চুল পড়া।
সকাল থেকে আমি না খেয়ে শুয়ে থাকলাম। উঠলাম একবারে দুপুরের পরে। তবুও মাথাটাকে সোজা করে ধরে রাখতে পারছিলাম না।
তিনটার দিকে হুজুর ও তার টিম যথারীতি আসলো। আমাদের বললো,
- একটা অন্ধকার রুম হলে সবচেয়ে ভালো হয়।
সেই অনুযায়ী আমাদের পাশের রুমটাতে তাদের বসতে বলা হলো।
কিছু সময় কি সব সাধনা করে হুজুর উঠে চলে আসলো রুম থেকে।
উঠে এসে আমাদের থেকে একটা কোদাল নিয়ে দরজার বাইরে কোপ দিতে থাকলো।
মাটির নীচ থেকে সে বের করে আনলো একটা পুতুল, পলিথিনে মোড়ানো কিছু তাবিজ আর সর্বশেষ আমার ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র।
আমাদের বললো,
-চলেন আপনাদের গোয়ালঘরে যাই।
গোয়ালঘরে গিয়ে গরুর লেজ থেকে আরেকটা তাবিজ উদ্ধার করলেন তিনি।
হুজুর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
- শুধুমাত্র আপনাকে হত্যা করার জন্য এগুলো করা হয়েছে। কে করেছে এটা শুনতে হলে আমার সাথে আপনাদের যেতে হবে।
মানুষটার উদ্দেশ্য যে কতটা নিকৃষ্ট তা এগুলো না দেখলে বুঝতে পারতাম না।
সবাই একসাথে গিয়ে পুতুলটার আদ্যোপান্ত দেখতে লাগলাম।
একটা প্লাস্টিকের তৈরি পুতুল। পুতুলের মাথায় ঠিক কপাল বরাবর একটা সুঁই ঢোকানো, হুজুর সেটা আমাকে দেখিয়ে বললো এটা আপনার মাথা ব্যথার কারণ। এই সুইটা মাটির চাপে যত পুতুলের মাথায় ঢুকতো আপনার মাথাব্যথা তত প্রকট আকার ধারণ করতো।
তারপর পুতুলের গলা বের করা হলো আমার শাশুড়ীর ছবি।
হুজুর আমাকে আবার দেখিয়ে বললো,
- আপনি বলতেন না আপনার মৃত শাশুড়ী আপনাকে গলা টিপে মারতে আসে, ছুরি দিয়ে মারতে যায়। মূলত সেটা ছিলো এই বান মারার জন্য যে জ্বীন ব্যবহৃত হয়েছে সে। সেই জ্বীনটায় আপনার সামনে আপনার শাশুড়ীর রূপে যেত।
ভয়ে আমি কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। শুধু আমার মা কে জড়িয়ে ধরে কান্না করছিলাম।
আমি কান্না করতে করতে জিজ্ঞাসা করলাম,
-হুজুর আমাকে মারতে চেয়েছিলো কে?
- সেটা জানার জন্য আমাদের সেই কবিরাজের কাছে যেতে হবে। যে এই কাজ করেছে।
- কে এই কবিরাজ?
- কবিরাজের নাম তারেক মুন্সী! কে সে?
সবুজ আর আমি দুজন দুজনের দিকে চেয়ে রইলাম।
- কি বললেন? তারেক মুন্সী?
সে আমার সম্পর্কে চাচা শশুড়।
সবাই মিলে চলে গেলাম তারেক মুন্সীর বাড়ি। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে রুমে দরজা লাগিয়ে ভেতরে বসে আছে।
সবুজ একটা লাঠি হাতে করে রাগে গদগদ করতে করতে রুমের দরজা ভেঙে ফেললো।
দরজা ভেঙে গিয়ে কষে কয়েকটা থাপ্পড় আর কিল ঘুষি মারলো তারেক মুন্সীকে!
শার্টের কলার ধরে সবুজ ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
- বল তোকে দিয়ে কে এই কাজ করিয়েছে?
বল!
মাইরের চোটে তারেক মুন্সী এক সময় বলে উঠলো,
- আমাকে মারছিস কেন? আমার কাজই তো এটা। তোর বাপকে কবর থেকে উঠে নিয়ে এসে মাইর দে যা। তোর বাপই সবকিছু করতে বলেছিলো আমাকে। তাই আমি করেছি।
আমাকে আর মারিস না বাবা!
সবুজ শার্টের কলার ছেড়ে দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। মানুষজন বলাবলি করছে,
- শশুড় হয়ে কেমন করে এসব কাজ করে। নিজের ছেলের বউ মেয়ের মতো! তার সাথে এমন কাজ করে কিভাবে। আজ যদি মেয়েটা মারা যেত?
কিছু সময় পরে সবুজ উঠে আবারো তারেক মুন্সীকে জিজ্ঞাসা করলো,
- কি জন্য এসব করেছে তোকে নিশ্চয়ই বলেছে। তুই এখন সব বলবি! আর এই বান নষ্ট করবি!
- আমি বলতেছি, তুই আমাকে আর মারিস না।
তোর বাবার সাথে আমার সম্পর্ক কেমন ছিল তা তোরা জানিস। তুই যখন পালিয়ে বিয়ে করলি তাতে তোর মায়ের অমত ছিলো সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তোর বাবা তোদের মেনে নিয়েছিলো। যদিও তোর মায়ের কারণে সরাসরি স্বীকার করতো না।
তোর মা গলায় দড়ি দিয়ে মারা গেলে তোর বাবা সম্পূর্ণ দোষারোপ করে তোর বউকে।
এ নিয়ে প্রায়ই আমার কাছে এসে আমাকে বলতো। আমাকে একদিন এসে বলে,
- ভাই, সবুজের বউটারে আমার আর সহ্য হচ্ছে না। আমার বউটারে সে এসেই গিলে খেয়েছে। যেই সংসারে আমার বউ থাকতে পারলো না, সেখানে অন্যের মেয়ে এসে হাসিমুখে সংসার করবে।তুই কিছু একটা ব্যবস্থা কর।
অনেক অনুনয় বিনয়ের পরে আমি তোর বাবাকে এসবের পরামর্শ দিয়েছিলাম।
সেই অনুযায়ী তোর বাবা গোপনে তোদের বাড়িতে যেত। রুমে ঢুকে বৌমার ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস নিয়ে আসতো সে। এমন ভাবে সব কাজ করা হয়েছিলো যেন কেউ টের না পায়।
তোরা যেদিন সোনাপুরের হুজুরের কাছে গেলি, তোর বাবা আমাকে এসে বললো আমরা দুজনেই ধরা পরে যাবো। কিছু একটা যেন ব্যবস্থা করি।
আমি সেই ভয়ে একটা জ্বীন দিয়ে ওই হুজুরকে মেরে ফেলি, আর পথে তোদের ভয় দেখাই।
আমি আর কিছু করিনাই!
সবুজ সাথে যাথে আরো দুইটা ঘুষি মেরে বললো,
- আর কি জানিস বল! আমার আব্বাকে কে মেরেছে!
কিছু সময় চুপ করে থেকে বললো,
- তোর বউয়ের মাথায় অনেক চুল আছে। তোর আব্বা বললো, চুলের কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিতে। তাই সেদিন গোয়ালঘরের বাইরে থেকে তোর বউয়ের মাথা থেকে তোর বাবা চুল নিয়ে আসে। তারপর সেটা দিয়ে রাখি ওই পুতুলে। যাতে তোর বউয়ের মাথার চুল সব ঝরে যায়।
কয়েকদিন আগে তোর বাবা তার সব ভুল বুঝতে পারে। আমাকে এসে বলে আমি যেন সব ঠিক করে নিই। কিন্তু ঘটনা অনেকদূর ঘটে গিয়েছে,
কিভাবে কি করা যায় সেই ভয়ে আমি......
হঠাৎ সবার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে যায় তারেক মুন্সী।
সবুজ হাত উঁচু করে বলে,
- বল বল কি করেছিস!
- আমিই তোর বাবাকে হত্যা করিয়েছি৷ যাতে আমি ধরা পরে না যাই। কিন্তু বুঝতে পারি নাই, এই হুজুরের কাছে এতো শক্তিশালী একটা জ্বীন আছে। যে আমার সব খবর ফাঁস করে দিয়েছে।
***
বান মারার সমস্ত জিনিস নষ্ট করে দেওয়া হলো। যেটার প্রভাব আমার জীবনে আর পড়বে না। পুলিশ ডেকে তারেক মুন্সীকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হলো। মামলা করা হলো একটা হত্যা ও আরেকটা হত্যাচেষ্টা মামলার আসামী করে।
তার শাস্তি তো সে পাবে। কিন্তু বাবা সমতুল্য একটা মানুষ যে অনেক আগেই শাস্তি পেয়ে গেলো। যে তার ভুল বুঝতে পেরেছিলো। কিন্তু তাতে কি লাভ হলো?
পাপের শাস্তি একদিন পরে আর আগে হোক তাকে তার ফল ভোগ করতেই হবে।
সমাপ্ত
কেমন লাগলো কমেন্ট বক্সে জানাবেন।
© bnbooks.blogspot.com
