সত্যিই কি এইরকম ঘটনা কখনও ঘটে? নাকি এগুলো সবই ওর মস্তিষ্ক প্রসূত?
কি জানি!
তবে সত্যি মিথ্যা যাই হোক না কেন? একটা ব্যাপার তো অবশ্যই আছে এই ঘটনাগুলোর মধ্যে। আর তা আমাকে মানতেই হবে। যতই আমি এই ঘটনাগুলো শুনছি, ততোই যেন এগুলোর উপর আমার কৌতুহল আর আকর্ষণ দুই-ই বেড়ে চলেছে। আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে... একটা গা ছমছম করা অদ্ভুত অনুভূতি!
সচরাচর এরকমটা কিন্তু আমার সাথে খুব একটা হয়না। আসলে ভৌতিক গল্পে বরাবরই আমি ভয়টা একটু কম পাই। তার উপর আবার একাধিক ভূতের গল্প লেখা এবং পড়ার সুবাদে, মনের ভিতর আজকাল ভয়ের অনুভূতিগুলোও যেন অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। তাই ভয় বিষয়টাকে এখন আর আমার দ্বারা উপভোগ করাও হয়ে ওঠেনা।
কিন্তু এই ঘটনাটা শোনার সময়, আজ বহুদিন বাদে আবার আমার সেই পুরোনো অনুভূতিগুলো পূণরায় সাড়া দিয়ে উঠলো। মনে হল, নিজের অজান্তেই সারা শরীরে একটা শিরশিরানি ভাব অনুভব করতে পারছি আমি। তাই অস্বীকার করার জায়গা নেই... কিছু তো একটা অবশ্যই রয়েছে এই গল্পটার মধ্যে, যেটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের উর্ধ্বে। তা না হলে কেনইবা শুধু শুধু আমার রোমকূপগুলো এতোদিন বাদে এইভাবে খাড়া হয়ে উঠবে?
সায়নীকে জিজ্ঞেস করলাম... "তারপর কি হল?"
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ও জবাব দিল...
- "তারপর কি হল, সেটা বলবো তো ঠিকই.. কিন্তু আপনি কি আর বিশ্বাস করবেন?
আমি অবাক হয়ে বললাম...
- "কেন করবো না? এতোক্ষন যদি বিশ্বাস করতে পারি, তাহলে এখন না করার কি আছে?"
একটু মৃদু হাসলো সায়নী। তারপর বলল...
- "আসলে কি বলুন তো, এই কদিনে আমি একটা কথা খুব ভালো করে বুঝে গেছি, যাদের সাথে এইসব অলৌকিক, অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে, তারা ছাড়া এই পৃথিবীর আর কেউ এগুলোকে বিশ্বাস করেনা। হয়তো করা সম্ভবও নয়।
তাই সামনাসামনি যেই যতো বলুক না কেন, সে আমার কথায় বিশ্বাস করছে। আমি জানি তারাও দূরে গিয়ে আমার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে। হয়তো হাসি ঠাট্টাও করে আমার কথা নিয়ে। তাই এখন আর কাউকে এসব বলতেও ইচ্ছা করেনা। মনে হয় যা ঘটার, তা তো আমার সাথে ঘটেই গেছে... কাউকে বলে কি লাভ?"
আমার মনে হল, খুব একটা ভুল কিছু বললো না সায়নী। সত্যিই তো... ওর কথাগুলো নিয়ে তো আমার মনেও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আমিও তো ওকে সম্পুর্ণ বিশ্বাস করতে পারছিনা। তাহলে ওর লাভ কি আমাকে বলে?
আমি সায়নীকে বললাম...
- "দেখ সায়নী... কে বিশ্বাস করলো, আর কে বিশ্বাস করলো না... তার উপর তো নির্ভর করে সত্যি কখনও পাল্টে যায়না। আর এটাও ঠিক যে এগুলো এমন একটা কথা, যা অনেকের পক্ষেই মেনে নেওয়া অসম্ভব। তাই তোমার যাকে মনে হবে ঘটনাগুলো বলার, তাকে তুমি অবশ্যই বোলো। এরপর সে কি ভাবলো না ভাবলো, সেটা না হয় তার উপরেই ছেড়ে দাও।"
এইবার সায়নী আর কোনো প্রশ্ন করলো না এই নিয়ে। ও নিজের সেই রাতের পরবর্তী ঘটনাগুলো আবার আমায় বলতে শুরু করলো...
সেদিন সন্ধ্যায় অটো করে বাড়ি ফেরার পথে মা আমায় পরিষ্কার জানিয়ে দিল... মা আর আমার কোনো কথাই শুনতে চায়না। আমি যেন বাড়ি ফিরেই ব্যাগপত্র সব গুছিয়ে ফেলি। আজ রাতেই আমরা রিষড়া ফিরে যাবো।
আমিও আর মায়ের মুখের উপর কোনো কথা বললাম না। সত্যি কথা বলতে কি, আমি নিজেও চাইছিলাম না যে আজ রাতটা আমি এখানে কাটাই। টুকাইয়ের ব্যাপারটা জানার পর থেকেই কেমন যেন একটা আতঙ্ক ঢুকে গেছিল মনের ভিতরে। বারবার মনে হচ্ছিল... সুলেখাদি হয়তো এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছে টুকাইকে নিজের কাছে রাখার জন্য। তাই তো ও প্রতিমুহুর্তে এইভাবে ফিরে ফিরে আসছে, আর আমাদের ভয় দেখাচ্ছে।
কিন্তু ও কি জানে না যে ও এখন আর টুকাইকে নিজের কাছে রাখতে পারবে না। কারণ ও তো মারা গেছে। আর একজন মরা মানুষ কি কখনও একজন জীবিত মানুষকে নিজের কাছে রাখতে পারে? এটা কি কখনও সম্ভব?
তারপরেই হঠাৎ করে আমার মনে পড়ল ওই কথাটা। মানুষ মৃত্যুর পর নিজের প্রিয়জনেরই সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে যায়। সে তখন প্রচণ্ডভাবে চেষ্টা করে নিজের প্রিয় মানুষটাকেও তার সাথে মৃত্যুলোকে টেনে নিয়ে যাওয়ার। সুলেখাদিও কি তাহলে সেই চেষ্টাই করছে? ও কি চাইছে টুকাইকে মেরে ফেলে ওর সাথে...
কথাটা ভাবতেই বুকের ভিতরটা প্রচণ্ড রকম কেঁপে উঠল আমার। অটোর মধ্যেই টুকাইকে চেপে জড়িয়ে ধরলাম আমি। মনে মনে বললাম...
- "হে ভগবান, যা ক্ষতি করার তুমি আমার করো... কিন্তু আমার ছেলেটার যেন কোনো বিপদ না হয়, সেই খেয়াল রেখো প্রভু।"
অনেকক্ষণ ধরেই মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল আমার। অটো থেকে নেমে বাড়ির দিকে যেতে যেতে সেটা জিজ্ঞেস করলাম মাকে...
- "আচ্ছা মা... সুলেখাদি যদি আমাদের বিল্ডিংয়ে আসতে পারে, আবার অতনুদার বাড়িতেও যেতে পারে... তাহলে আমরা রিষড়ায় চলে গেলে, ও কি আর সেখানে যেতে পারবে না?"
আসলে অতনুদার কাছে সব কথাগুলো শোনার পর থেকে টুকাইকে নিয়ে এতো বেশি দুশ্চিন্তা হচ্ছিল, যে ছোটো ছোটো সম্ভাবনাগুলোও যেন বড্ড বেশি ভাবিয়ে তুলছিল আমায়।
মা দেখলাম কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আমার মুখের দিকে। হয়তো মেয়ের অসহায়তাটা মা তখন খুব ভালো ভাবেই আন্দাজ করতে পারছিল। তাই খুব শান্ত গলায় বলল...
- "তুই চিন্তা করিস না মাম্পি... ও রিষড়ায় যেতে পারলেও যাবেনা। আসলে কি বলতো, মৃত্যুর পর মানুষের আত্মা প্রধানত দুটো জায়গাতেই ঘোরাফেরা করে... এক, ও যেখানে মরেছিল... আর দুই, ও যেখানে থাকতো। তাই টুকাইকে নিয়ে আমরা যদি রিষড়ায় চলে যাই, তাহলে ওর আর ক্ষতির সম্ভাবনা নেই।"
মায়ের কথায় মনে মনে বেশ সাহস পেলাম আমি। ভেবে নিলাম বাড়ি ফিরেই তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে বেড়িয়ে পড়তে হবে। আর একটা রাতও এখানে কাটানো ঠিক হবে না।
***************************************
শান্তিনীড়ের গেটের সামনে পৌঁছেই, সন্ধ্যার আলো আধাঁরিতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা দৈত্যাকার বিল্ডিংটাকে দেখে বুকের ভিতরটা আবার কেমন যেন ছ্যাঁত করে উঠল। মনে হল এই অন্ধকার বিল্ডিংয়েরই কোনো এক অন্ধকার কোনায়, ন্যাড়া মাথায় লাল টিপ পরে ঘাপটি দিয়ে বসে আছে সুলেখাদি। ওর পান খাওয়া লাল টকটকে লোভী জিভ দিয়ে হয়তো এখন টপটপ করে লালা পড়ছে টুকাইয়ের জন্য।
ছেলেটাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে আমি ভয়ে ভয়ে পা রাখলাম লিফটের ভিতর। দরজাটা বন্ধ হওয়ার পরই কেন জানি আমার মনে হল... আজ হয়তো এখানে কিছু একটা অঘটন ঘটতে পারে। তারপর থেকেই নিজের নিশ্বাস আটকে মারাত্মক এক উৎকণ্ঠায় আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম দরজাটা খুলে যাওয়ার। পাশে দাঁড়ানো মা'ও হয়তো আমার এই আতঙ্কটা বুঝতে পারছিল। তাই অনুভব করলাম একটা হাত আমার কাঁধটাকে শক্ত করে ধরল। মা হয়তো বোঝাতে চাইল... ভয় পাসনা, আমি তোর সাথে আছি। লিফট নিজের মতো উপরের উঠে চলল...
একতলা... দোতলা... তিনতলা....
তারপর... চারতলায় এসে দাঁড়িয়ে গেল ওটা। দরজাটা খুলে যেতেই আমি যেন একটা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
আমার পাশ দিয়ে মা প্রথমে বেড়িয়ে গেল বাইরে। তারপর আমি যখন টুকাইকে নিয়ে বেরোতে যাচ্ছি, ঠিক তখনই আমার খেয়াল হল... হাতটা যেন এখনও আমার কাঁধটাকে শক্ত করে চেপে ধরে আছে! আমি চেষ্টা করেও এগোতে পারছি না!
একি... মা তো লিফটের বাইরে!!! তাহলে এটা কার হাত???
ভয়ে আতঙ্কে আমার সম্পুর্ণ শরীরটা এবার থরথর করে কেঁপে উঠল। আমি জোর করে বেরোনোর জন্য ছটফট করতে লাগলাম। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হলোনা। অদৃশ্য একটা হাত যেন আমার দেহের ওজন শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল তখন। লিফটের বাইরে থেকে মা বিরক্তির সুরে চিৎকার করে বলল...
- "কিরেএএ... বেরোচ্ছিস না কেন? বেরোওওও..."
এর উত্তরে আমি মা'কে নিজের দুরবস্থার কথা বলতেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই দেখলাম... লিফটের দরজাটা আবার নিজের থেকেই বন্ধ হতে শুরু করলো!
আমি টুকাইকে নিয়ে পাগলের মতো চেষ্টা করতে লাগলাম দরজার দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য শক্তিবলে আমার পা দুটো যেন লিফটের মেঝেতেই জমাট বেঁধে আটকে রইলো। দরজাটা যখন প্রায় বন্ধ হয় হয় অবস্থা, তখন দেখলাম হঠাৎ করে মা এসে ওর মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাতে দরজাটা আবার আগের মতো খুলে গেল, আর আমিও অনুভব করলাম... আমার কাঁধের উপর এখন আর কারো হাতের স্পর্শ নেই।
মা আমায় প্রচণ্ড বকা দিয়ে জিজ্ঞেস করল...
- "কিরে... পাগল হয়ে গেছিস নাকি? বেরোচ্ছিস না কেন লিফট থেকে?"
কিন্তু সেই মুহুর্তে মায়ের কোনো প্রশ্নের জবাব দেওয়ার অবস্থায় আমি ছিলাম না। টুকাইকে নিয়ে দ্রুত গতিতে লিফট থেকে বেরিয়ে এসে ঘরের কলিং বেল টিপলাম আমি।
নাঃ... আর একমুহুর্তও না... এক্ষুনি... এক্ষুনি এই ফ্ল্যাট ছাড়তে হবে আমাদের। নইলে ভয়ঙ্কর বিপদ ঘটে যাবে।
কিন্তু মানুষ যতোই পরিকল্পনা করে রাখুক না কেন? তাতে ভবিতব্যের কখনও কোনো পরিবর্তন হয়না। আর সেই রাতে এই ব্যাপারটা আমি খুব ভালো করেই বুঝেছি।
দু-তিনবার বেল বাজানোর পর বাবা ব্যস্ত হয়ে এসে যখন দরজাটা খুলল, তখনই বাবার বিধ্বস্ত মুখ দেখে বুঝেছিলাম... বড়সড় একটা অঘটন অবশ্যই ঘটেছে। কিন্তু কি ঘটেছে সেটা জিজ্ঞেস করার আগে, বাবা নিজেই উত্তেজিত গলায় আমায় বলল...
- "ওহ.. তুই এসেছিস? আমি তোকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম... তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে যা.. দেখ গিয়ে তোর শাশুড়ির কি হয়েছে?"
কথাটা শুনেই ছুটে গেলাম রান্নাঘরের দিকে। সেখানে গিয়ে দেখলাম, রান্নাঘরের মধ্যেই একটা চেয়ারে মাথা এলিয়ে বুকে হাত দিয়ে বসে আছেন শাশুড়ি মা। ওনাকে এই অবস্থায় দেখা মাত্রই আমার যেন পায়ের তলার মাটি সরে গেল। তাড়াতাড়ি গিয়ে ওনার বুকটা ডলে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলাম...
- "কি হয়েছে মা?"
উনি খুব ধীরে ধীরে জবাব দিলেন...
- "বড্ড ব্যাথা করছে..."
বাবা বলল...
- "আমরা দুজনে তো একসাথে বসেই টিভি দেখছিলাম। উনি বলল, আপনি বসুন আমি একটু চা করে নিয়ে আসি। তখনও কিন্তু সুস্থই ছিলেন। তারপর চা করতে এসে, কি যে হল জানি না। হঠাৎ একটা আওয়াজ পেয়ে রান্নাঘরে ছুটে এসে দেখি, উনি মাটিতে পড়ে বুক ধরে দাপাদাপি করছেন। কোনোরকমে মাটি থেকে উঠিয়ে চেয়ারে বসিয়েছি আর তখনই তোরা এসেছিস।"
আমি বাবার উপর রাগ দেখিয়ে চিৎকার করে বললাম...
- "চেয়ারে বসানোর কি ছিল? একটু কোলে করে তুলে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শোওয়াতে পারলে না?"
বাবা দেখলাম হতভম্বের মতো আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। মা আমাকে বলল...
- "এই মাম্পি... কি বলছিস এইসব? বাবা কি এগুলো পারে নাকি করতে?"
আসলে শাশুড়ি মা'কে দেখে তখন আমার এতোটাই দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে গেছিল যে বাবার সাথে ওনার সম্পর্কটাও আমি ভুলে গেছিলাম। আর তাছাড়া আমি বিশ্বাস করি... মানুষের জীবনের থেকে কোনো সম্পর্ক কখনও বড় হতে পারেনা। কিন্তু এইসব নিয়ে তর্ক করার সময় তখন আমার ছিলনা। কোনোমতে আমি আর মা মিলে ধরাধরি করে শাশুড়ি মাকে বিছানায় শুইয়েই, সাথে সাথে ফোন করলাম ডাক্তারকে। তারপর শাশুড়ি মায়ের মাথার পাশে বসে বুকে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম।
ডাক্তার এলেন মিনিট কুড়ি পর। এরপর শাশুড়ি মাকে ভালো করে চেক করে... কয়েকটা মেডিসিন আর টেস্ট লিখে দিয়ে বললেন...
- "ওনার একটা মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। এখন আমি একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে যাচ্ছি। এতে উনি ঘুমিয়ে পড়বেন। বাইচান্স রাতে যদি ঘুম ভেঙে গিয়ে কোনো অসুবিধা হয়, বা ব্যথা করছে বলে তাহলে এই দুটো ওষুধ খাইয়ে দেবেন। আর কাল সকালে অবশ্যই টেস্টগুলো করিয়ে নেবেন।"
হার্ট অ্যাটাক শব্দটা শুনেই আমার হাত-পাগুলো কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে এল। আমি ডাক্তার বাবুকে বললাম...
- "টেনশনের কোনো ব্যাপার নেই তো ডাক্তার বাবু? মানে আপনি যদি বলেন... তাহলে কিন্তু আমি হসপিটালেও অ্যাডমিট করাতে পারি।"
ডাক্তার বাবু মৃদু হেসে বললেন...
- "ওরকম যদি বুঝতাম, তাহলে কি আমি ঘরে ফেলে রাখতে বললাম? চিন্তা করবেন না। খুবই মাইল্ড অ্যাটাক। আচমকা কোরোনারি ব্লকেজ হয়ে গেলে এরকম হয়। আপনি ওষুধগুলো আনিয়ে রাখুন, আর কাল একবার টেস্টগুলো করিয়ে নেবেন।"
ডাক্তার বাবু শাশুড়ি মাকে ইঞ্জেকশন দিয়ে চলে গেলেন। আমাদের গেটের দারোয়ানটাই ডাক্তার বাবুকে সাথে করে নিয়ে এসেছিল আমাদের ঘর অবধি। আমি ওর হাতেই টাকা আর প্রেসক্রিপশনটা দিয়ে ওষুধগুলো আনিয়ে নিলাম।
কেন জানি খুবই বিধ্বস্ত লাগছিল নিজেকে। অরিন্দম এখানে নেই। তারমধ্যে ওর মায়ের যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে আমি মুখ দেখাবো কি করে? কথাটা ভেবেই মনটা তখন এতোটা ভারি হয়েছিল যে অন্য চিন্তাগুলো মাথা থেকে সম্পুর্ণ বেরিয়েই গেছিল।
আসলে মানুষের অদৃশ্য বিপদ যতই বড় হোক না কেন, চোখের সামনের বিপদ সবসময়ই তাকে ভুলিয়ে দিতে পারে। আর আমার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছিল সেদিন। শাশুড়ি মায়ের এইরকম অবস্থা দেখে সুলেখাদির ভয় কখন যেন ভুলেই গেছিলাম আমি।
কিন্তু ভয়কে আমরা ভুলে থাকতে চাইলেও, ভয় যে আমাদের বেশিক্ষণ ভুলে থাকতে দেয়না। ওর সময় হলেই ও ঠিক ফিরে আসে স্বমহিমায়। আর এর প্রমাণও আমি পেয়েছিলাম সেই রাতে।
সন্ধ্যেবেলায় ডাক্তার বাবু ইঞ্জেকশন দিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর সেই যে শাশুড়ি মা ঘুমিয়ে ছিলেন, আর ওঠেন নি ঘুম থেকে। আমরাও ওনাকে সুস্থ দেখে ধীরে ধীরে নিশ্চিন্ত হয়ে উঠছিলাম।
সেই রাতে আমাদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে গেছিল। খাওয়ার পর আমি মাকে বলেছিলাম, যাতে মা আর বাবা আমার ঘরে শুয়ে পড়ে। আমি না হয় টুকাইকে নিয়ে শাশুড়ি মায়ের ঘরে শুয়ে পড়বো। কিন্তু মা তাতে রাজি হয়নি। মা বলেছিল...
- "এইটুকু বিছানায় তোরা তিনজন শুতে পারবি না। তার চেয়ে তুই আর টুকাই বরং তোর ঘরেই শো। আমি এখানে থাকছি তো। কোনো অসুবিধা হলে ডাকবো তোকে।"
এরপর আমি আর কোনো কথা বলিনি। টুকাইকে নিয়ে নিজের ঘরে এসে দরজা ভেজিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। সারাদিনের দৌড়ঝাঁপ আর চিন্তায় এতোটাই ক্লান্ত হয়েছিলাম যে শোওয়া মাত্রই কখন যে দুচোখ বুজে ঘুম নেমে এসেছিল... বুঝতেই পারিনি।
***************************************
রাত তখন ঠিক কটা বেজেছিল মনে নেই। হঠাৎ ঘুমের চোখে শুনতে পেলাম, মা আমায় ডাকছে। চোখ খুলে তাকাতেই দেখলাম, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মা বলছে...
- "মাম্পি... হনুমান চালিশাটা শিগগিরি নিয়ে আয় তোর শাশুড়ির ঘরে।"
আমি ঘুমের চোখেই টুকাইয়ের বালিশের তলা থেকে হনুমান চালিশাটা নিয়ে ছুটে গেলাম শাশুড়ি মায়ের ঘরে। সেখানে গিয়ে দেখলাম বাবা, মা, আর শাশুড়ি তিনজনেই জেগে। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়ে শাশুড়ি মাকে জিজ্ঞেস করলাম...
- "কি হয়েছে মা? আবার বুক ব্যাথা করছে?"
তা শুনে আমার মা বলল...
- "না না... এখন আর ওনার বুক ব্যথা করছে না। তবে দাঁড়িয়ে থেকে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়েছিল তো। তাই মাথা, কোমড়, হাঁটু এসব জায়গায় চোট পেয়েছেন। ওখানেই ব্যথা করছে এখন। তোকে ডাক্তার যেই ওষুধটা দিতে বলেছিল সেটা দিয়ে দে।"
আমি শাশুড়ি মাকে ওষুধ খাইয়ে ওনার পিঠ, কোমড় এইসব জায়গাগুলো মালিশ করে দিতে লাগলাম। এরমধ্যে বাবা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল...
- "তখন কি হয়েছিল আপনার? হঠাৎ করে পড়ে গেলেন কেন?"
বাবার প্রশ্ন শুনে শাশুড়ি মা ধীরে ধীরে আমার মুখের দিকে ঘুরে তাকালো। তারপর খুব ক্ষীণ কন্ঠে আমায় বলল...
- "তখন জানো তো, রান্নাঘরে আমি চা বানাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হল কে যেন রান্নাঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। আমি ভাবলাম চারতলার জানালায় কে আবার উঁকি দিচ্ছে? বিড়াল টিরাল হবে হয়তো। ঘুরে তাকাতেই কি দেখলাম জানো?"
আমি বললাম.. "কি?"
শাশুড়ি মা চোখদুটো বড়বড় করে বলল...
- "আমি দেখলাম জানালা দিয়ে সুলেখা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে..."
শুনেই বুকটা আমার ধড়াস করে উঠল। তবু কোনোমতে নিজের ভয়টাকে সামলে বললাম...
- "না মা.. আপনি হয়তো ভুল দেখেছেন।"
শাশুড়ি মা উত্তেজিত গলায় বলল...
- "অসম্ভব... সেই লাল টিপ... সেই কাজল পরা চোখ... সেই পান খাওয়া লাল ঠোঁট... আমি কিছুতেই ভুল দেখতে পারিনা। তারপরেই তো বুকটা প্রচণ্ড ব্যাথা করে উঠল। চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেল। আর আমি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেলাম।"
কি বলবো কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি জানি শাশুড়ি মা মিথ্যা বলছেন না। কিন্তু এই অবস্থায় ওইসব কথা আমি ওনাকে আর ভাবতে দিতে চাইছিলাম না। তাই সান্ত্বনা দিয়ে বললাম...
- "ঠিক আছে ছাড়ুন তো মা। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন তো আমি এসে গেছি, আর কোনো ভয় নেই।"
শাশুড়ি মা হয়তো এবার একটু নিশ্চিন্ত হলেন। তাই বালিশে মাথা রেখে আবার চোখ বুজলেন। আমি ওনার কোমড় মালিশ করে দিতে থাকলাম।
কিছুক্ষন পরে হঠাৎ মা আমায় বলে উঠল...
- "আরে.... এই হনুমান চালিশাটা এখানে কি করে এল? এটা তো আমি টুকাইয়ের বালিশের নিচে রাখতে বলেছিলাম তোকে।"
আমি অবাক হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম...
- "আশ্চর্য... তুমিই তো আমায় বললে এই ঘরে নিয়ে আসতে।"
- "আমি!!!!!" মা বিস্মিত মুখে আমার দিকে তাকালো। আর সাথে সাথেই আমার শরীরের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো যেন থরথর করে একসাথে কেঁপে উঠল।
টুকাই ওই ঘরে একা শুয়ে আছে... আর ওর বালিশের নিচে এখন হনুমান চালিশাটাও নেই! আমি কাঁপতে কাঁপতে হনুমান চালিশাটা নিয়ে ছুটে গেলাম আমার ঘরে। আর সেখানে পৌঁছে আমি যা দৃশ্য দেখলাম... তাতে বুকের ভিতর আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন একমুহুর্তের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে গেল!
ঘরের নাইট ল্যাম্পের আলোয় আমি পরিষ্কার দেখলাম... টুকাই বিছানার উপর ঘুমিয়ে আছে, আর ওই একই বিছানার উপর ওর ঠিক পাশেই বসে আছে একটা কালো রঙের ছায়ামূর্তি। আর সেই ছায়ামূর্তি তখন কি যেন একটা করছিল টুকাইয়ের শরীরে। এইবার আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। আমার গলা দিয়ে চিৎকার বেরিয়ে এল....
- "টুকাআআআআআইইইই....."
অন্ধকারের মধ্যেই ছুটে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলাম টুকাইকে। ততক্ষনে বাবাও এসে লাইট জ্বালিয়ে দিয়েছিল ঘরের। আলো জ্বলার পর আমিও আর দেখতে পাইনি সেই ছায়ামূর্তিকে। তবে টুকাইয়ের গলায়, বুকে, আর ঘাড়ে বেশ কয়েকটা পাঁচ আঙ্গুলের নখের আঁচড় স্পষ্ট দেখতে পারছিলাম তখন।
সেই রাতে আমরা আর কেউই দু চোখের পাতা এক করতে পারিনি। সবাই লাইট জ্বালিয়ে একটা ঘরেই বসে ছিলাম। তারপর ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই গাড়ি ভাড়া করে চলে এসেছিলাম রিষড়ায়। এখনও আমরা সবাই রিষড়াতেই আছি। অরিন্দমও পুণে থেকে ফিরে এখানেই থাকছে।
অতনুদার সাথে অরিন্দমের কথা হয়েছে ফোনে। ওদের নাকি দোষ কাটানোর পুজো হয়ে গেছে, এখন আর কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তাই আমাদেরও ফিরতে বলছিল ফ্ল্যাটে। কিন্তু আমি চাইছিলাম ফেরার আগে যদি একবার ফকির বাবার সাথে দেখা করতে পারতাম তাহলে ভালো হতো।
সব শুনে আমি বলেছিলাম...
- "দেখ সায়নী, ফকির বাবার ঠিকানা তো আমি ঠিক জানিনা। তবে সে না হয় জিজ্ঞেস করে নেবো। কিন্তু আমি যতদূর জানি উনি এখন আর ওখানে থাকেন না। তাই ওনাকে পাওয়া মুশকিল।
তবে আমার মনে হয় অতনুদা যখন নিজেই বলছেন, পুজো দেওয়ার পর আর কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তাহলে হয়তো সত্যিই সব ঠিক হয়ে গেছে। তবু তোমায় বলবো নিজের মনের শান্তির জন্য ফকির বাবার মতো অন্য ভালো কাউকে খুঁজে বের করে একবার কথা বলে নাও। সে যদি বলেন যেতে... তবেই না হয় ফিরো। এতে তোমরাও নিশ্চিন্ত হতে পারবে।"
আমার কথা শুনে সায়নী বলেছিল...
- "ঠিক আছে, তাই করবো না হয়। দেখি ভালো কাউকে খুঁজে পাই কিনা।"
এই ঘটনার সপ্তাহ খানেক পর সায়নীর সাথে আর একবারই কথা হয়েছিল আমার। ও তখন জানিয়েছিল.. ওরা এখনই ফিরছে শান্তিনীড়ে। কবে ফিরবে তারও ঠিক নেই। তবে ওখানে ফেরার পর যদি কখনও কোনো অসুবিধা হয়, তাহলে ও নিশ্চয়ই জানাবে আমায় সেই ঘটনা।
কিন্তু এখন ওরা সকলেই বেশ ভালো আছে। সায়নীর ভাই নিজের ফ্যামিলি নিয়ে মুম্বাই শিফট হয়ে যাওয়ায়, ওদের ঘরেরও আর কোনো অসুবিধা নেই।
সব শুনে ওদের জন্য মনে মনে বলেছিলাম...
- "ঈশ্বর.. ওদের তুমি ভালো রেখো.."
সমাপ্ত
© bnbooks.blogspot.com
