হনুমান চালিশাটা বলতে বলতে কখন যে ঘুম এসে গেছিল নিজেও জানিনা। ঘুম ভাঙলো পরেরদিন সকালবেলায় মায়ের ডাক শুনে...
- "কিরে, আর কত বেলা অবধি ঘুমাবি... এবার ওঠ!"
লম্বা একটা হাই তুলে, আড়মোড়া ভেঙে খাট থেকে নামতে যেতেই হঠাৎ নজর পড়ল আমার ঘরের আলমারিটার দিকে। দেখেই বুকের ভিতরটা কেমন যেন ছ্যাঁত করে উঠল। মনে পড়ে গেল গতরাতে ওইটার সামনেই তো দাঁড়িয়ে ছিল কালো ছায়ামূর্তিটা।
কিন্তু তারপর যেন কি হল? আমি যেন কি করলাম? ঠিক মনে করে উঠতে পারছি না।
ঘটনাটা আরও একবার মনে করার চেষ্টা করার চেষ্টা করলাম আমি।
ও হ্যাঁ... মনে পড়েছে। ছায়ামূর্তিটা ধীরে ধীরে আমার দিকেই এগিয়ে আসছিল। আমিও ভয় পেয়ে হনুমান চালিশা বলতে শুরু করেছিলাম। এরপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি... নিজেও জানিনা। তারমানে ওটা যে ছিল বা যাই ছিল, সেটা আর আমাদের কোনো ক্ষতি করে উঠতে পারেনি। মনের মধ্যে কেমন যেন এক অদ্ভুত সাহস পেলাম আমি। বুঝতে পারলাম... এই কদিন ধরে সর্বক্ষণ আমাদের আশেপাশে যে নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ দিয়ে বেড়াচ্ছে, সে যতই ভয় দেখাক না কেন... আমাদের কোনো ক্ষতি করার ক্ষমতা তার নেই।
কথাটা মাথায় আসতেই সকাল সকাল নিজেকে বেশ হালকা আর চাপমুক্ত বলে মনে হল আমার। মা আরও একবার জিজ্ঞেস করেছিল আমায়...
- "কিরে, রিষড়া যাবি আজকে? চল, চলে যাই। শুধু শুধু এই বিপদের মধ্যে পড়ে থেকে কোনো লাভ নেই।"
আমিও খুব আত্মবিশ্বাসের সুরে মাকে বলে ছিলাম...
- "তোমাকে বললাম তো যেতে হলে কাল যাব। কিন্তু আজ আমাকে একবার অতনুদার বাড়ি যেতেই হবে। আর তুমি এইসব নিয়ে বেশি চিন্তাভাবনা কোরোনা। আমাদের কোনো ক্ষতি হবেনা।"
কিন্তু তখনও বুঝিনি, আমার এই আত্মবিশ্বাস কত বড় বিপদের মধ্যে ঠেলে দিতে চলেছে আমায়। যদি বুঝতাম, তাহলে হয়তো মায়ের কথা সেদিন কোনোমতেই অমান্য করতাম না আমি।
যাই হোক, মা আর এই নিয়ে আমায় খুব বেশি জোরাজুরি করেনি। বলার মধ্যে শুধু এইটুকুই বলেছিল...
- "অতনুদার বাড়ি যেতে হলে, তোর সাথে আমি যাব। একা একা তোকে কিছুতেই যেতে দেব না।"
আমিও আর এই নিয়ে মায়ের সাথে কোনো তর্ক করিনি। মনে মনে ভেবেছিলাম, মা গেলে ভালোই হবে। রাস্তায় কথা বলতে বলতে যাওয়া যাবে। আসলে মেয়েদের এমন অনেক কথা থাকে যেগুলো বাড়িতে শাশুড়ির সামনে বলতে অসুবিধা হয়।
সকালের দিকে সেদিন আর কোনোরকম অসুবিধা হয়নি আমাদের। টুকাইয়ের শরীরটাও একদম ফিট হয়ে গেছিল। গতরাতে যেই গা গরম ভাবটা ছিল, সেটাও তখন আর ছিলনা। আমি ভেবে রেখেছিলাম, দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর্ব মিটিয়ে তারপর যাবো অতনুদার বাড়ি। সেই অনুযায়ী কাজগুলো সব সেরে রাখছিলাম।
মাঝে বাবা একবার ডাক দিয়ে বলল...
- "মাম্পি দেখ তো আমার ঘাড়ের কাছটা, আর পিঠের দিকটায় কি হয়েছে? কেমন যেন জ্বালা জ্বালা করছে!"
দেখলাম, বাবার ঘাড়ের আর পিঠের তিন-চার জায়গায় নখের আঁচড়ের দাগ। মানুষ যখন শরীরের কোনো জায়গায় খুব জোরে চুলকোয়, আর তারফলে সেই জায়গাটা চিরে গিয়ে, লম্বা লম্বা পাঁচটা দাগ হয়ে যায়। অনেকটা ঠিক ওইরকমই। আমি বাবার পিঠে মলম লাগিয়ে দিয়ে বললাম...
- "কাল রাতে কি তোমায় মশা কামড়েছে নাকি? এইভাবে চুলকেছো কেন? ইশশশ... দেখ তো, কি অবস্থা হয়েছে পিঠটার।"
বাবা বেশ অবাক হয়ে বলল...
- "মশা...? কই না তো! আমি তো কিছু টের পাইনি।" তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলল...
- "কি জানি! হয়তো ঘুমের ঘোরে হয়ে গেছে।"
***************************************
সেদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে করতে প্রায় আড়াইটে বেজে গেছিল। তারপর থালাবাসন মেজে সব গুছিয়ে গাছিয়ে রাখতে সময় লেগেছিল আরও আধ ঘন্টা। এই বাড়িতে আসার পর আমি এখনও কাজের লোক জোগাড় করে উঠতে পারিনি। তাই সব কাজ নিজেকেই করতে হয়। তবে ওইদিন মা হাতে হাতে করে দেওয়ায় সময় একটু কম লেগেছিল।
আমরা যখন অতনুদার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম, তখন ঘড়িতে সোওয়া তিনটে বাজে। এখানে আমরা বলতে আমি, মা, আর টুকাই। শাশুড়ি মা অবশ্য বলেছিলেন টুকাইকে বাড়িতে রেখে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কেন জানি আমি না থাকাকালীন টুকাইকে ওই বাড়িতে রাখতে ঠিক সাহস পাচ্ছিলাম না। তাই ওকে সঙ্গে নিয়েছিলাম।
আমাদের বাড়ি থেকে অতনুদার বাড়ি অটোতে গেলে মিনিট পনেরোর রাস্তা। কিন্তু অসুবিধা একটাই। ওই রুটের অটোটা একটু
কম পাওয়া যায়।
যাই হোক, আমরা যখন ওনার বাড়ির কাছে গিয়ে পৌঁছালাম... তখন প্রায় চারটে ছুঁই ছুঁই। গেটের সামনে থেকে ভিতরের দিকে তাকাতেই মনে হল গোটা বাড়িটা কেমন যেন থমথম করছে। যদিও বহুদিনের পুরোনো এই দোতলা বাড়িটার সম্পুর্ণটা অতনুদাদের নয়। ওরা শুধু একতলাটা কিনেছিল। দোতলায় অন্য একটা পরিবার থাকে। গেট খুলে ভিতরে যেতেই অতনুদার মা আমাকে দেখে বলল...
- "তুমি সায়নী না?"
মাসখানেক আগে সুলেখাদির সাথে আমি একবারই মাত্র এসেছিলাম এখানে। তাও মাত্র আধাঘণ্টার জন্য। তখনই পরিচয় হয়েছিল অতনুদার মায়ের সাথে।
আমি মৃদু হেসে বললাম...
- "হ্যাঁ মাসিমা... আচ্ছা অতনুদা আছেন?"
ওনার মুখটা দেখলাম হঠাৎ করে কেমন যেন কালো হয়ে গেল। উনি এবার আমার মায়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই, আমি আবার বললাম...
- "এটা আমার মা"
মাসিমা এবার খুব নির্লিপ্ত গলায় বললেন...
- "ওহ আচ্ছা.." তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন...
- "অতনু আছে... যাও ওর ঘরে"
অতনুদার পরিবারে মা ছাড়াও দাদা, বৌদি আর দুই ভাইপো আছে। তাদের মধ্যে একজন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে, আরেকজন এইবার মাধ্যমিক দেবে। একতলায় ঘর বলতে তিনটে। এতোগুলো মানুষের মাত্র তিনটে ঘরে থাকার অসুবিধা হয়ে যাচ্ছিল বলেই সুলেখাদির কথায় নতুন ফ্ল্যাটটা কিনেছিলেন অতনুদা। কিন্তু ভাগ্যে যদি ভোগ করার সুখ না থাকে, তাহলে হয়তো রাজরানি হয়েও কোনো লাভ হয়না। সীতার মত আজীবন সেই বনবাসেই দিন কাটাতে হয়।
পর্দা সরিয়ে যখন অতনুদার ঘরে ঢুকলাম, তখন উনি মাথার উপর একটা হাত রেখে নিজের বিছানায় শুয়ে আছেন। আমাদের দেখেই কোনোমতে বিছানার উপর উঠে বসে বললেন...
- "ওহ, তুমি এসেছো? জানতাম আসবে।"
অতনুদাকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম আমি! একি চেহারা হয়েছে ভদ্রলোকের? রোগা পাতলা উনি আগাগোড়াই ছিলেন ঠিকই। কিন্তু এখন কেমন যেন শুকিয়ে কঙ্কালসার হয়ে গেছেন। তারমধ্যে মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে। চোখের নিচেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কালির ছাপ। ঠোঁট গুলোও শুকিয়ে কেমন সাদা হয়ে গেছে। দেখে মনে হল এই চার পাঁচদিনেই অতনুদার বয়স যেন এক ঝটকায় চল্লিশ বছর বেড়ে গেছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম...
- "আপনি কি করে জানলেন আমি আসবো?"
আমার প্রশ্ন শুনে মৃদু হাসলেন অতনুদা। কিন্তু কোনো উত্তর দিলেন না। তারপর আমাকে আর মা'কে অবাক করে দিয়ে নিজের জামার বোতামগুলো খুলতে লাগলেন উনি। আমরা দুজনেই হতভম্বের মতো চেয়ে রইলাম ওনার দিকে।
কিছুক্ষণ বাদেই নিজের জামাটা সম্পুর্ণ খুলে খালি গায়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন উনি। আর সাথে সাথেই ওনাকে দেখে আঁতকে উঠলাম আমরা।
একি!!!! ওনার সারা গায়ে এগুলো কিসের দাগ???
দেখে মনে হচ্ছে অতনুদার সম্পুর্ণ শরীরটা কেউ যেন যথেচ্ছ নখের আঁচড়ে চিরে চিরে দিয়েছে। লাল লাল রক্ত জমে রয়েছে সেইসব দাগে।
অতনুদার এই ভয়াবহ অবস্থা দেখে তখনই দুটো কথা আমার মাথায় চলে এল।
এক... মানুষ যদি নিজের শরীরে জোরে চুলকোয় তাহলে সাধারণত চার আঙ্গুলেরই দাগ পড়ার কথা! বুড়ো আঙ্গুলটা তখন অতোটা কাজে আসেনা। পাঁচ আঙ্গুলের দাগ তখনই পড়বে যখন কেউ কাউকে ইচ্ছাকৃত খিমচি দিয়ে ধরে আঁচড় কাটবে।
আর দুই নম্বর হল... নিজের পিঠের এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে মানুষের পক্ষে হাতের পাঁচটা আঙ্গুল দিয়ে এইভাবে চুলকানো সম্ভবই নয়।
কথাগুলো মাথায় আসতেই আমার বুকের ভিতরটা হঠাৎ করে ধড়াস করে উঠল। কারণ আমি জানি অতনুদার সাথে এগুলো কে করেছে। তারমানে বাবাকেও কি কাল রাতে সেই-ই......
উফফফ... কথাটা চিন্তা করতেই আমার শরীরটা কেমন যেন ভয়ে শিউরে উঠল।
অতনুদা ততোক্ষণে জামাটা আবার পরে নিয়ে বিছানায় বসে বললেন...
- "আমি টানা পাঁচরাত পাঁচদিন জেগে আছি। ও আমাকে কিছুতেই ঘুমাতে দেয়না। যখনই দুচোখের পাতা এক হয়ে আসে, তখনই ও আমার শরীরের উপর বসে সারা দেহে নখের আঁচড় কাটতে থাকে। ব্যাথায় যন্ত্রণায় দাপিয়ে উঠে ঘুম ভেঙে যায় আমার।"
একটু থামলেন অতনুদা। তারপর আবার বললেন...
- "আর, শুধু কি ঘুম? ও আমায় ঠিক করে খেতেও দেয়না এখন। কখনও ভাত ভর্তি থালা মাটিতে ফেলে দেয়, আবার কখনও ঝোলের বাটিতে জলের গ্লাস উল্টে দেয়। কিছুতেই শান্তিতে থাকতে দেবেনা ও আমায়। ওর রাগ, ওর জেদ এখনও শান্ত হয়নি আমার উপর।"
একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেড়িয়ে এল অতনুদার গলা থেকে। তারপর টেবিলে রাখা ওনার আর সুলেখাদির বিয়ের ছবিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন...
- "আমি জানি ও হয়তো আমায় আর বাঁচতে দেবেনা। আর সত্যি কথা বলছি, তাই নিয়ে আমার কোনো আফসোসও নেই। তোমরা শুধু টুকাইকে একটু সাবধানে রেখো। ও খুব ভালোবাসতো তো টুকাইকে, তাই তোমরা না বললেও জানি তোমাদের বাড়িতে কিছু না কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা অবশ্যই ঘটছে। আর সেইজন্যই আমি নিশ্চিত ছিলাম তোমরা আসবে এখানে।"
আমি এবার অতনুদার চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম...
- "অতনুদা... কেন করলো সুলেখাদি এমন? কি এমন ঝগড়া হয়েছিল আপনাদের মধ্যে যে ওকে এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে হল?"
অতনুদা দেখলাম এই প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের মাথাটা নত করে নিলেন। বুঝলাম না উনি কি লুকাতে চাইছেন আমাদের থেকে। কিন্তু মা এইবার বেশ রাগী গলায় বলে উঠল...
- "দেখুন অতনুবাবু... আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর ঝামেলার কারণ জানার আমাদের কোনো শখ নেই। কিন্তু এটা কেমনতর কথা মশাই... আপনারা অশান্তি করবেন, আপনার স্ত্রী আত্মহত্যা করবে... আর তার ফল ভোগ করবে আমার মেয়ে? আপনিই বলুন না, এটা কি কোনো যুক্তিসংগত ব্যাপার হল?"
অতনুদা এইবার মাটির দিকেই দৃষ্টি রেখে খুব ঠাণ্ডা গলায় বললেন...
- "আমি যদি বলি, সুলেখার আত্মহত্যা করার পিছনে কারণ একমাত্র টুকাই... তাহলে কি কথাটা বিশ্বাস করবেন আপনারা?"
আমার বুকের ভিতর হঠাৎ করে যেন একটা প্রচণ্ড বজ্রাঘাত হল! চিৎকার করে বললাম..
- "মানেএএএএ... কি বলতে চাইছেন আপনি???"
অতনুদা সেই একইরকম ঠাণ্ডা গলায় বললেন...
- "হ্যাঁ... একদমই ঠিক বলছি।" টেবিল থেকে সুলেখাদির ফটোটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে, সেটার কাচের উপর হাত বোলাতে বোলাতে অতনুদা বলতে লাগল...
- "বিয়ের পর পরই ডাক্তার আমাদের বলে দিয়েছিল সুলেখার বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা কম। ওর ওভারিতে এমন একটা প্রবলেম আছে, যার কারণে ওর সন্তান ধারণ করার ক্ষমতা ৯০ শতাংশ নেই বললেই চলে। কিন্তু সুলেখার মাথায় গেঁথে গেছিল... দশ শতাংশ চান্স এখনও আছে যে ও মা হতে পারবে। আর সব সময় সেই আশাতেই থাকতো ও। কিন্তু সময় যত গড়াতে লাগল, ওর স্বপ্ন ততই ভাঙতে থাকল। ধীরে ধীরে ও কেমন যেন ডিপ্রেশনে চলে যেতে শুরু করল। বিভিন্নরকম মনের রোগ দানা বাঁধতে থাকল ওর ভিতর। আমি ওকে কাউন্সিলিং করানোর চেষ্টাও করেছিলাম কয়েকবার, কিন্তু ও তাতে রাজি হয়নি।
দিনকে দিন ওর রাগ, তেজ, জেদ, অভিমান সবকিছুই বাড়তে থাকল। মেজাজ খারাপ হয়ে থাকা, কথায় কথায় যার তার সাথে ঝগড়া করা... এগুলো যেন ওর সারাক্ষণের সঙ্গী ছিল। আমি ওকে কতো বুঝিয়েছিলাম যে অনাথ আশ্রম থেকে একটা বাচ্চা না হয়, দত্তক নিয়ে নিই। কিন্তু নাঃ... ওর একটাই জেদ, ওর নিজের বাচ্চা চাই।
শেষে ভাবলাম এই পরিবেশ ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে থাকলে হয়তো ওর মনটা ভালো হবে। তাই জন্য ওই শান্তিনীড়ের ফ্ল্যাটটাও কিনলাম। কিন্তু তখন বুঝিনি যে ওই ফ্ল্যাট কেনাটাই আমার জীবনে এতো বড়ো বিপদ ডেকে আনবে।"
আমার আর মায়ের মুখে তখন কোনো কথা আসছিল না। আমরা অধীর আগ্রহে অতনুদার দিকে তাকিয়ে ছিলাম ওনার পরবর্তী কথাগুলো শোনার জন্য। উনি আবার বলতে শুরু করলেন...
- "সুলেখা যেদিন প্রথমবার আপনাদের বাড়িতে গেছিল, সেদিনই টুকাইকে দেখে ওর ভালো লেগে গেছিল। ওই প্রথম আমি দেখেছিলাম, একজন অন্য কারোর সন্তানের উপর সুলেখার অতো মায়া জন্মেছিল। তারপর ওই মায়া, ওই ভালো লাগা থেকেই সুলেখার মনে টুকাইয়ের প্রতি এসেছিল এক অকৃত্রিম ভালোবাসা। আর সেই ভালোবাসার থেকেই জন্ম নিয়েছিল এক নিঃসন্তান মায়ের মাতৃত্বের টান। ক্রমশ সুলেখা যেন টুকাইকে নিজের সন্তান বলেই ভাবতে শুরু করছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম... ও আবার একটা আঘাত খেতে চলেছে। তাই ওকে সাবধান করতাম, বাধা দিতাম। কিন্তু ও আমার কথা কিছুতেই শুনতো না। দিনে দিনে টুকাইয়ের প্রতি ওর টান এমন পর্যায়ে চলে যেতে লাগল যে ও সারাক্ষন স্বপ্ন দেখতো টুকাইকে নিজের কাছে রাখার।"
অতনুদা নিজের কথা আবার থামালেন। তারপর একটা হাত বাড়িয়ে টুকাইকে নিজের কাছে ডাকলেন। টুকাই সোফা থেকে উঠে ওনার দিকে এগোতেই যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই আমি ওর হাত ধরে ওকে ওখানেই আটকে দিলাম। অতনুদা আমার এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করে মৃদু হাসলেন। তারপর একটা লম্বা নিশ্বাস ছেড়ে আবার ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন....
- "সুলেখা যেদিন মারা গেল... তার আগেরদিন সন্ধ্যায় আমি যখন অফিস থেকে ফিরলাম, ও তখন আমায় একটা অদ্ভুত কথা বলল। ও বলল... আমি যেন তোমাদের বাড়িতে গিয়ে, অরিন্দম আর তোমার সাথে কথা বলি যে টুকাইকে আমরা দত্তক নিতে চাই।"
অতনুদার কথাটা শুনেই চমকে উঠলাম আমি!
সুলেখাদি এরকম কথা বলেছিল? এতো ভয়ঙ্কর একটা কথা ও মাথায় আনলো কি করে? আমার ছেলেকে পছন্দ হয়েছে বলেই, ওকে দিয়ে দিতে হবে? এটা কি মামাবাড়ির আবদার নাকি? প্রচণ্ড রাগে গা'টা আমার রিরি করে উঠল। অতনুদা হয়তো আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই আমার দিকে তাকিয়ে উনি বললেন...
- "হ্যাঁ... কথাটা শুনে ঠিক তোমার মতোই চমকে উঠেছিলাম আমি। ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম... কেউ কারো সন্তানকে কেন শুধু শুধু তোমায় দিতে যাবে? তাতে ও আমায় যুক্তি দিয়েছিল... ওর সন্তান ধারণে অসুবিধা আছে, কিন্তু তোমার বা অরিন্দমের সেই অসুবিধা নেই। তাই তোমরা চাইলেই আবার দ্বিতীয় সন্তান নিতে পারবে। কিন্তু ওর সেই বিকল্প নেই।"
মা এইবার আর নিজের ধৈর্য রাখতে পারল না। হঠাৎ করেই চিৎকার করে উঠল...
- "কেন... ও কি এটাকে মগের মুলুক পেয়েছি নাকি যে বিকল্প থাকলেই নিজের পেটের সন্তান ওকে দিয়ে দিতে হবে? আশ্চর্য মহিলা তো.."
অতনুদা মায়ের দিকে তাকিয়ে খুব ভদ্রভাবে বললেন...
- "মাসিমা... যেই মেয়েটার কথা বলছেন আপনি, সে কিন্তু এখন আর বেঁচে নেই।"
আমি মা'কে ইশারায় চুপ করতে বলে, অতনুদার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললাম...
- "তারপর কি হয়েছিল?"
অতনুদা বিছানায় একটু হেলান দিয়ে বসে, আবার বলতে শুরু করলেন...
- "সেইরাতে খুব ঝগড়া হয়েছিল আমাদের। ও আমাকে হাজারবার হাজার রকম ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, আমি যাতে টুকাইকে তোমাদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে আসি। কিন্তু আমি প্রতিবারই ওকে না বলেছি। আসলে সত্যি কথা বলতে কি... সুলেখার একটা মানসিক রোগ থাকলেও, আমার তো সেটা ছিল না। তাই ঠিক ভুলের পার্থক্যটা আমি জানতাম।
যাই হোক, যেটা বলছিলাম। সেদিন একটা সময় আমাদের অশান্তি এত চরম সীমায় পৌঁছে গেছিল যে আমাকে বাধ্য হয়ে জীবনে প্রথমবার ওর গায়ে হাত তুলতে হয়েছিল। তারপর আর ও আমার সাথে ওইদিন একটাও কথা বলেনি। সারারাত কিচ্ছুটি না খেয়ে বিছানার একটা কোনায় বসে অনবরত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই গেছিল।
জানো সায়নী... মেয়েটাকে দেখেনা সেইদিন আমার সত্যিই বড্ড কষ্ট হচ্ছিল গো। কিন্তু কি করবো বলো? আমারও যে হাত-পা বাঁধা। ভেবেছিলাম একটা দিন কেঁদে নিক, তাহলে হয়তো মনের কষ্টটা হালকা হবে। কিন্তু পরেরদিন আমি বাজারে বেরোতেই ও যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে ওরকম করে ফেলবে... সেটা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল।"
লক্ষ্য করলাম অতনুদার চোখদুটো জলে ভিজে গেছে। ওনাকে দেখে আমারও কেন জানি চোখটা ছলছল করে উঠল। গলার স্বর একদম নরম করে বললাম...
- "সুলেখাদিকে আপনি যে এত ভালোবাসেন, সেটা কি ও দেখতে পাচ্ছে না? তারপরেও এত কষ্ট দিচ্ছে কেন আপনাকে?"
অতনুদা এবার মৃদু হাসলেন আমার কথায়। তারপর একটা উদাস বললেন...
- "বেঁচে থাকতেই যে নিজের রাগ, জেদ, অভিমানের সামনে আমার ভালোবাসাটা দেখতে পেলনা। মরে যাওয়ার পর তার কাছ থেকে আর এসব আশা করি কি করে বলো? এখন তো ওর কাছে আর মানুষের মতো হৃদয়ও নে....."
অতনুদা কথাটা সম্পুর্ণ করার আগেই একটা জোরালো ধপ্ শব্দে আমরা চারজনেই চমকে উঠলাম। তাকিয়ে দেখলাম টেবিলের উপর রাখা জল ভর্তি প্লাস্টিকের বোতলটা মেঝেতে পড়ে আছে।
অতনুদা হঠাৎ প্রচণ্ড উত্তেজিত গলায় চিৎকার করে বললেন...
- "তাড়াতাড়ি... তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাও তোমরা... ও এসে গেছে... টুকাই এখানে থাকলে অসুবিধা হতে পারে... ফাস্ট... ফাস্ট... আর একমুহুর্তও দেরী কোরানা..."
বুকের ভিতরটা যেন ধড়ফড় করে কেঁপে উঠল আমার। তার সাথেই অনুভব করলাম শরীরটা যেন হঠাৎ করেই ভারি হয়ে গেল। গায়ের রোমগুলোও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে খাড়া হয়ে উঠল। কিন্তু শরীর নিয়ে এতকিছু ভাবার সময় এখন আমার নেই। অতনুদা অনবরত বলেই যাচ্ছিলেন...
- "ফাস্ট... ফাস্ট.... ফাস্ট..."
ঘরের ভিতর আবার আরেকটা যেন কিসের শব্দ হল।
কিন্তু আমি আর কোনোদিকে না তাকিয়ে একটানে টুকাইকে নিয়ে ছুটে চললাম ঘরের বাইরের দিকে। শুনতে পেলাম অতনুদা পিছন থেকে চিৎকার করে বলছেন...
- "যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওই ফ্ল্যাট ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাও তোমরা। সুলেখার শ্রাদ্ধ হয়ে গেলেও, ওর কিন্তু দোষ পাওয়া গেছে... ভয়ঙ্কর মৃত্যুকালীন দোষ... তাই যতক্ষণ না আমি সেই দোষ কাটানোর উপাচার করছি। ততোক্ষন কিন্তু তোমরা ভুলেও ফিরে এসো না... নইলে বিপদ হতে পারে... ঘোর বিপদ..."
অতনুদার শেষ কথাগুলো যেন আমার বুকে তীরের মতো এসে বিঁধলো। কিন্তু আজ রাত যে আমাকে থাকতেই হবে ওই ফ্ল্যাটে। আজকেই যদি কিছু হয়... ভয়ে আতঙ্কে সারা শরীরটা কেমন যেন দুমড়ে মুচড়ে এল আমার।
সন্ধ্যার হালকা অন্ধকারে টুকাইকে কোলে নিয়ে আমি আর মা তখন ছুটেই চলেছি.... কোথায় যাচ্ছি জানি না। কিন্তু যে করেই হোক অতনুদার বাড়ি থেকে আমাদের দূরে যেতেই হবে। যতোটা দূরে সম্ভব...
চলবে
© bnbooks.blogspot.com
