- "একটু আগেই আমি ওকে দেখলাম রে মাম্পি।"
ওহ... বলা হয়নি, মাম্পি হল আমার ডাক নাম। বাপের বাড়ির সবাই আমায় ওই নামেই ডাকে। আমি বিস্মিত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম...
- "দেখলে মানে! কাকে দেখলে?"
মা মুখটা কালো করে নিয়ে ভয় জড়ানো চাপা গলায় বলল...
- "সুলেখাকে..."
বুকের ভিতরটা ধড়াস করে উঠল আমার। এটা কি করে সম্ভব? মা তো কোনোদিন ওকে দেখেই নি। শেষবার যখন গৃহপ্রবেশের সময় মা এখানে এসেছিল, তখন তো সুলেখাদির সাথে আমার পরিচয়ই হয়নি। তাহলে মা চিনলো কি করে?
কথাটা জিজ্ঞেস করতেই, মা বলতে শুরু করল...
- "তোরা যখন টুকাইকে নিয়ে বেরিয়ে গেলি, তার কিছুক্ষণ পরেই তোর শাশুড়ি আমায় বলল... চা খাবেন দিদি? তাহলে একটু চা বানিয়ে আনি।
তাই শুনে আমিও বললাম... থাক আপনার করতে হবে না। আপনি বসুন, আমিই করে আনছি।
এইবলে রান্নাঘরে এসে চায়ের জলটা বসালাম। ততোক্ষণে বাইরে অন্ধকার নেমে গেছে। ঘরের ভিতর লাইট জ্বলছে। খেয়াল করে দেখেছিস নিশ্চয়ই, তোদের রান্নাঘরের আলোটা জ্বালালে বাঁদিকের দেওয়ালটাতে একটা আবছা ছায়া পড়ে?"
আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম। মা আবার বলতে শুরু করলো...
- "আমি তখন ফুটন্ত জলে চা পাতাটা ঢালতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার নজর পড়লো বাঁদিকের দেওয়ালটার দিকে। আমি দেখলাম সেখানে পরপর দুটো ছায়া পড়েছে। একটা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে চা পাতার কৌটো। আরেকটা ছায়া দেখলাম বসে আছে, তার হাঁটু দুটো বুকের কাছে ভাজ করা। কিন্তু ওইসময় রান্নাঘরে আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি ছিলনা।"
কথাটা শুনেই আমার বুকের ভিতরটা কেমন যেন শুকিয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় মাকে জিজ্ঞেস করলাম...
- "তারপর তুমি কি করলে?"
- "কি আবার করবো? তাড়াতাড়ি করে চা বানিয়ে ঘরে চলে এলাম।"
বিস্ময়ে আমার মুখ দিয়ে তখন কোনো কথা আসতে চাইছিল না। মা যে বরাবরই একটু ডানপিটে আর সাহসী গোছের মহিলা এটা আমার জানা। আর মায়ের এই গুণের কিছুটা অংশ হয়তো আমিও পেয়েছি। কিন্তু তাই বলে ওইরকম একটা দৃশ্য দেখার পরও ওখানে দাঁড়িয়ে চা বানানোর সাহস, আমার অন্তত নেই। মাকে জিজ্ঞেস করলাম...
- "তুমি ভয় পেলেনা? মানে কোনো অসুবিধা হল না তোমার?"
মা দেখলাম এবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল...
- "ভয়? না, ভয় তো সেরকম পাইনি। আসলে, তুই তো জানিসই এইসব ব্যাপার আমার কাছে নতুন না। বিয়ের পর পরই আরও দুবার আমার সাথে ঘটেছিল এইরকম ঘটনা। তখন অবশ্য তোরা কেউ হোস নি। কিন্ত এইবার যেন..."
মা একটু থামলো। আমি কৌতুহলী গলায় প্রশ্ন করলাম...
- "কিন্তু এইবার যেন কি???"
- "কিন্তু এইবার যেন আমার ব্যাপারটা ঠিক সুবিধের বলে মনে হচ্ছে না। তোর কাছ থেকে সুলেখার সম্পর্কে আমি যাই শুনেছি... তাতে আমার মনে হয়েছে ও বরাবরই খুব জেদি ছিল। তা নাহলে মরার আগে কেউ নিজের মাথার চুল কেটে ন্যাড়া হয় কখনও? কতোটা তেজ, কতোটা পাগলামি থাকলে একটা মানুষ এইরকম করতে পারে, সেটা ভেবে দেখেছিস? আমার তো কেন জানি মনে হচ্ছে, ও মরার আগে হয়তো ল্যাংটো হয়ে পুরো ঘরে উদ্দাম নৃত্য করেছিল আর পাগলের মত হেসেছিল।
আসলে জেদি মানুষেরা এইরকমেরই হয়। ওদের যখন মাথায় রক্ত উঠে যায়, তখন ওরা নিজেদের যন্ত্রণা দিতে ভালোবাসে।
মায়ের মুখ থেকে এই ধরণের বর্ণনা শুনে আমার সারা শরীরটা কেমন যেন অস্থির করে উঠল। চোখের সামনে যেন পর পর ভেসে উঠল সম্পুর্ণ দৃশ্যটা...
সুলেখাদি নিজের ফাঁকা ফ্ল্যাটের মেঝেতে বসে কাঁচি দিয়ে কচকচ করে কেটে যাচ্ছে নিজের মাথার চুল। গোছা গোছা সেই চুল এসে জড়ো হচ্ছে ওর পায়ের সামনে। এইবার ও ন্যাড়া মাথায় ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। ওর কপালে তখনও একটা বড় লাল টিপ, চোখে কাজল আর ঠোঁটে রক্তের মতো গাঢ় লাল লিপস্টিক। এইবার একে একে নিজের শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ আর অন্যান্য পোশাক খুলে ফেলে নির্লজ্জের মতো নগ্ন হয়ে দাঁড়ালো সুলেখাদি। তারপর পাগলের মতো উদ্দাম নৃত্য করতে করতে দাপিয়ে বেড়াতে লাগলো ফাঁকা ফ্ল্যাটের এক ঘর থেকে আরেক ঘরে। তারমধ্যেই ও কখনও উন্মাদের মতো অট্টহাসি হাসতে থাকল... আবার কখনও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।
এইসব কিছুর মাঝেই হঠাৎ করে ওর হাতে উঠে এল, কেরোসিন তেল ভর্তি একটা পাঁচ লিটারের ড্রাম। তারপর জলে ভেজা চোখ নিয়ে হাসতে হাসতে সেই ড্রামের তেল ঢেলে ফেলল নিজের মাথার মধ্যে। ওর সিঁদুরের টিপ, চোখের কাজল গলে পড়তে লাগল নাক দিয়ে, গাল দিয়ে। ড্রামের তেল শেষ হতেই সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মাটি থেকে একটা দেশলাই তুলে নিল ও। তারপর একটা কাঠি জ্বালিয়ে, সেটা নিজের শরীরে ছোঁয়ানোর আগে অন্তিম বার পাগলের মতো খিকখিক করে হাসলো সুলেখাদি। তারপরেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। আর সারা ঘর ছেয়ে গেল দম বন্ধ করা একটা বিশ্রী মাংস পোড়া গন্ধে।
উফফফফ... আমার নিশ্বাসটা কেমন যেন বন্ধ হয়ে এল। মনের হল চোখের সামনে দেখতে পারছি ওই জ্বলন্ত আগুনের লেলিহান শিখাগুলোকে। আর তার মধ্যে একবুক জেদ নিয়ে বসে আছে সুলেখাদি। চামড়া পোড়ার যন্ত্রণাও ওর মুখ দিয়ে একটু আর্তনাদ বের করতে পারছে না... এতো ওর অভিমান... এতো ওর রাগ।
- "কিরে মাম্পি... কি ভাবছিস তুই?"
মায়ের ধাক্কায় হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে এল আমার। কখন যে ঘামে ভিজে গেছি, নিজেও জানি না।
- "কিরে, এতোক্ষন ধরে যে এতো কিছু বলে গেলাম... কিছু শুনতে পারলি তুই?"
আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললাম...
- "না তো মা... কিছুই শুনতে পাইনি।"
মা একমুহুর্ত আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন চিন্তা করলো। তারপর বলল...
- "থাক... ওইসব আর না শুনলেও হবে। এখন যেটা বলছি সেটা শোন... কাল সকাল হলেই তাড়াতাড়ি করে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিবি। এই বাড়িতে আর একটা দিনও থাকা চলবে না। আমরা সবাই মিলে কাল রিষড়া চলে যাব।"
মায়ের কথা শুনে সেদিন যদি আমি রাজি হয়ে যেতাম, তাহলে হয়তো পরেরদিন আমাদের অতো বড় বিপদের মুখে পড়তে হতো না। কিন্তু কথায় বলে... কপালের লিখন, খণ্ডাবে কে?
তাই তো মাকে আমি বলেছিলাম...
- "না মা... এতোদিন যখন ভয়ে ভয়ে কাটিয়ে দিলাম। আরও একটা দিন না হয় ভয় পেয়েই কাটিয়ে দেব। কিন্তু কাল রিষড়া যাওয়া আমার হবে না। যেতে হলে পরশুদিন যাব।"
মা অবাক হয়ে বলেছিল...
- "কিন্তু কেন? কাল তোর কি এমন কাজ আছে এখানে?"
- "কাল দুপুরের পর আমি একবার বেরোবো। অতনুদার বাড়ি যেতে হবে। আমাকে জানতেই হবে কি এমন ঘটলো ওদের মধ্যে যার জন্য সুলেখাদি এইভাবে সুইসাইড করলো। এটা জানতে না পারলে আমি যে রিষড়াতে গিয়েও শান্তি পাবোনা মা।"
- "তারজন্য ওর বাড়ি যাওয়ার কি আছে? ফোন করে নিলেই তো পারিস।"
- "দুইদিন ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছি। ফোন সুইচড অফ। হয়তো লোক লজ্জার কারণে বন্ধ করে রেখেছে। তাই কাল একবার আমাকে ওখানে যেতেই হবে।"
এরপর মা আর কোনো কথা বলেনি। বুঝেছিল হয়তো আমাকে বারণ করে কোনো লাভ হবে না। তাই নিজের মেয়ের জেদের কাছে একরকম চুপ করেই যেতে হয়েছিল।
ঘড়িতে যখন প্রায় রাত পৌনে আটটা বাজে, তখন আমাদের দরজায় কলিং বেলের আওয়াজ হল।
বুঝতে পারলাম বাবা এতোক্ষনে সিগারেট খেয়ে, পান চিবুতে চিবুতে বাড়ি ফিরেছে। বাবার আবার নিজের পছন্দ মতো পান না হলে মুখে রোচে না। আর পান সব দোকানে বানায় না। তাই খুঁজে পেতে সময় লেগেছে। মা উঠে দরজা খুলতে যাচ্ছিল। আমি বললাম...
- "তুমি বসো। আমি দেখছি।"
দরজা খুলতেই দেখলাম বাবা সিঁড়ির দিকে কেমন আশ্চর্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমায় দেখেই বলল...
- "বউটা কে রে?"
আমি অবাক হয়ে বললাম...
- "কোন বউ?"
- "কেন... একটু আগে তোর ঘরে কেউ আসেনি?"
- "কই না তো... কেউই তো আসেনি।"
বাবা চোখেমুখে কেমন যেন একটা বিস্ময়ের ছাপ নিয়ে ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকে এল। বুঝতে পারলাম, বাবার সাথেও কিছু একটা অদ্ভুত নিশ্চয়ই ঘটেছে, যার উত্তর বাবা এখনও মেলাতে পারেনি।
দরজাটা বন্ধ করেই বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম...
- "কি হয়েছে? কাকে দেখেছ তুমি?"
বাবা বেশ কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো আমার দিকে তাকিয়ে রইল... তারপর চোখদুটো সরিয়ে নিয়ে বলল...
- "না মানে, কি হল বলতো... আমি লিফটে আসছিলাম... হঠাৎ করে লিফটটা তিন তলায় এসে থেমে গেল, আর দরজা খুলে গেল। আমি বারবার সুইচ টিপলাম, কিন্তু দরজা বন্ধ হল না। তারপর ভাবলাম একটা তলার তো ব্যাপার... আমি না হয় সিঁড়ি দিয়েই চলে যাই। সেই মতো, সিঁড়ি দিয়েই আসছিলাম। তখন ফাঁকাই ছিল সিঁড়িটা, আমি ছাড়া অন্য কোনো লোকজন ছিলনা। বাঁকের কাছে এসে হঠাৎ আমি দেখতে পেলাম, চারতলা থেকে একটা লম্বা চওড়া মহিলা নিচের দিকে নামছেন। আমি ভাবলাম তোদের ঘরেই এসেছে বুঝি। কারন চারতলায় তো তোরা ছাড়া আর কেউ থাকেনা।
যাই হোক, আমি যখন ওই মহিলাটিকে পাশ কাটিয়ে উপরে উঠতে যাচ্ছি... তখন ও হঠাৎ করে আমায় বলল... টুকাই এখন কেমন আছে? আমিও ওর দিকে তাকিয়ে বললাম.. ভালো আছে। জ্বরটা নেমেছে এখন।
কথাটা বলেই একটা ধাপ উপরে উঠে, আচমকা আমার মনে হল... মহিলাটি যদি তোর ঘরেই গিয়ে থাকে, তাহলে টুকাই কেমন আছে সেটা আমায় জিজ্ঞেস করার কি হল? উনি তো নিজেই দেখে এসেছেন।
সাথে সাথেই পিছনে ঘুরে তাকালাম আমি। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে গেলাম এটা দেখে যে সিঁড়িতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। তাড়াতাড়ি নেমে এলাম বাঁকের মুখে। কিন্তু তলার সিঁড়িগুলোও একদম ফাঁকা। আমার একটা ধাপ উঠতে না উঠতেই, একজন মহিলা কি করে এতোগুলো সিঁড়ি পেড়িয়ে যেতে পারে... সেটাই তখন বুঝে উঠতে পারছি না। তারপর থেকেই কেন জানি একটা অস্বস্তি হচ্ছে। শরীরের ভিতরটা কেমন যেন লাগছে, ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।"
বাবার কথা শুনে আমার হাত-পা ততক্ষনে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কাঁপতে থাকা গলায় বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম...
- "তুমি দেখেছ বউটাকে? কেমন ছিল দেখতে?"
বাবা বলল...
- "তোদের সিঁড়িগুলোতে এমনিতেই খুব কম পাওয়ারের আলো... তারমধ্যে তাকিয়েও ছিলাম একমুহুর্তের জন্য। ভালো করে দেখতেও পাইনি। তবে এইটুকু মনে আছে... গোলগাল মুখ ছিল আর কপালে একটা বড় লাল টিপ।"
বাবার কথা শুনে আমার বুকের ভিতরটা যেন ধড়াস করে উঠল। এও কি কখনও সম্ভব? একটু আগে বাবা যার সাথে কথা বলেছে, সেই মানুষটা কিনা মারা গেছে আজ থেকে চার পাঁচদিন আগে। হে ঈশ্বর...
মাথার ভিতরে সবকিছু কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল আমার।
***************************************
সেই রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর ঠিক হল মা আর শাশুড়ি মা এক রুমে শোবে। আমি আর টুকাই শোবো আমাদের রুমে। আর বাবা শোবে হলরুমের ডিভাইনে। যদিও আমি বাবাকে বহুবার বলেছিলাম আমাদের রুমে শুতে। কিন্তু বাবা রাজি হয়নি। আগেই বলেছি, এই মানুষটা কোনোদিনই কারো কথা শোনেনি। নিজের যা ভালো মনে হয় বরাবর তাই করে এসেছে।
যাই হোক সেদিন এগারোটার মধ্যে আমরা যে যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। ওহ বলা হয়নি... টুকাইয়ের আর সেভাবে জ্বর আসেনি। গা-টা হালকা গরম ছিল ঠিকই, তবে বুঝতে পারছিলাম ওষুধ চলতে থাকলে কালকে এটাও সেরে যাবে।
মা শোয়ার আগে এসে একটা লোহার সাঁড়াশি রেখে গেল আমাদের তোষকের তলায়। আর সাথে করে একটা হনুমান চালিশার বই রেখে দিল টুকাইয়ের বালিশের পাশে। আমায় বলল...
- "রাতে ভয় পেলে হনুমান চালিশাটা পড়িস। আর কোনো অসুবিধা হলে আমায় ডাক দিস।"
আমি বললাম...
- "আমার তো পিরিয়ড চলছে, এরমধ্যে হনুমান চালিশা পড়তে পারবো?"
মা বলল...
- "বইটা না ছুলেই হল। তোর তো মুখস্থ। মনে মনেই পড়িস।"
এরপর আমি দরজা ভেজিয়ে টিউব লাইটটা অফ করে, নাইট ল্যাম্প জ্বালিয়ে শুয়ে পড়লাম। গতকাল প্রায় সারারাতই জাগা ছিলাম, তাই আজ চোখে ঘুম ধরতে বেশি সময় লাগল না।
রাত তখন কটা বাজে ঠিক জানা নেই। কেমন যেন একটা অদ্ভুত অস্বস্তিতে ঘুমটা ভেঙে গেল আমার। মনে হল ঘরটা যেন অস্বাভাবিক রকমের গরম হয়ে উঠেছে, তার সাথে একটা বিচ্ছিরি গন্ধও নাকে আসছিল আমার। ঘুমের চোখে আমি বুঝে উঠতে পারলাম না কিসের এই বাজে গন্ধ। তবে মনে হল গন্ধটা আমার খুব চেনা...
কিসের যেন গন্ধ... কিসের গন্ধ...
হঠাৎ মনে পড়লো আমার। এটা তো সেই মাংস পোড়া গন্ধ! বুকটা যেন ছ্যাঁত করে উঠল আমার। এক নিমিষে চোখের থেকে ঘুমটা উড়ে গেল। আমি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালাম। আর সাথে সাথেই যেই দৃশ্য আমি দেখলাম, তাতে আমার সর্বাঙ্গ ভয়ে আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠল।
ঘরের লালচে নাইট ল্যাম্পের আলোয় আমি পরিষ্কার দেখতে পারলাম একটা লম্বা চওড়া শাড়ি পরা ছায়ামূর্তি আমার বিছানা থেকে মাত্র হাত দুয়েক দূরত্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ও যে তখন আমাদের দিকেই দেখছে সেটা বুঝতে আমার আর কোনো অসুবিধা হল না। জমাটা কালো সেই ছায়ামূর্তিটার দিকে তাকিয়েই আমার সারা শরীরের রক্ত যেন এক লহমায় জল হয়ে গেল। আমার নিশ্বাসটা যেন গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে আটকে রইল। কাঁপা কাঁপা হাতে আমি বিছানার পাশের বেডসুইচটার দিকে হাত বাড়ালাম।
ঘরের আলো জ্বলে ওঠা মাত্রই আশ্চর্য হয়ে গেলাম আমি।
আরে এখানে তো কেউ নেই। ঘর তো একদম ফাঁকাই পড়ে আছে। তাহলে কি কোনো স্বপ্ন দেখছিলাম আমি? নাকি ওটা আমার কোনো মনের ভুল ছিল?
কি জানি... হয়তো তাই। সারাদিন এসব নিয়ে এতো ভাবছি, সেইজন্যই হয়তো ভুলভাল স্বপ্ন দেখেছি। নিশ্চিন্ত হয়ে আবার লাইটটা নিভিয়ে দিলাম আমি।
কিন্তু এ কি!!!! আলো নেভা মাত্রই আমার নজরে পড়ল, ছায়ামূর্তিটা তো এখনও সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। চাপ চাপ কালো অন্ধকারে ওর চোখমুখ ভালো করে বোঝা না গেলেও, ও যে প্রচণ্ড রাগে আমাকেই দেখছে... সেটা আমি ভালোই বুঝতে পারছিলাম।
আমি তাড়াতাড়ি আবার বেড সুইচটা অন করলাম।
কিন্তু এইবার কেন জানি আর আলো জ্বললো না। মারাত্মক ভয়ে আমি অনবরত সুইচটা অন অফ করতেই থাকলাম। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হলনা। আরও একবার আড়চোখে ছায়ামূর্তিটার দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম আমি।
ওটা যেন বেশ কিছুটা এগিয়ে এসেছে খাটের দিকে। এইবার কি করবো আমি? মা দের ডাকবো চিৎকার করে? নাকি টুকাইকে নিয়ে ঘর থেকে ছুটে পালাবো? কিন্তু খাটের সামনেই তো ও দাঁড়িয়ে আছে। তাহলে কি করবো এখন?
হঠাৎ আমার মনে পড়লো হনুমান চালিশার কথাটা। আমি তাড়াতাড়ি নিজের চোখ বন্ধ করে নিয়ে মনে মনে বলতে লাগলাম...
জয় হনুমান জ্ঞ্যানগুন সাগর,
জয় কপিস তিহু লোক উজাগর....
পুরো হনুমান চালিশাটা অনবরত বলেই যেতে থাকলাম।
একবার... দুবার... তিনবার... অসংখ্যবার।
© bnbooks.blogspot.com
