ও কেন কাঁদে - পর্ব ৩ - ভৌতিক গল্প

ও কেন কাঁদে
লেখক: কল্যান সরকার
পর্ব ৩

এতোদূর জানার পর হঠাৎ করেই একটা প্রশ্ন এসেছিল আমার মনে। সায়নীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম...
- "আচ্ছা, তোমার কথা শুনে যা বুঝেছি... তাতে তো তোমাকে বেশ সাহসী আর বাস্তব মনোভাবাপন্ন একটা মেয়ে বলে মনে হয়েছিল আমার। কিন্তু তারপরেও তুমি এতো সহজে ওইসব ভূত প্রেত অলৌকতায় বিশ্বাস করে নিলে? একটু ভেবে দেখলে না যে হতেই পারে ওগুলো সবই তোমার মনের ভুল। তাছাড়া মানুষের বাথরুমে চুল পড়ে থাকা কি অস্বাভাবিক কিছু? সে তো সবার বাথরুমেই থাকে। কিন্তু তাই বলে সেটা যে সুলেখাদিরই চুল হতে হবে... এ কথা তোমায় কে বলে দিল? একটু ভেবে বলো তো, তুমি যা বলছো... সেগুলো কি বর্তমানে এই বিজ্ঞানের যুগে বিশ্বাস করা যুক্তিসংগত?"
আমার প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেছিল সায়নী। ও হয়তো আমার কাছ থেকে এই ধরণের কথা আশা করেনি। আসলে আমি নিজেও এর আগে বেশ কিছু সত্যি ঘটনা অবলম্বনে ভৌতিক গল্প লিখেছি। এবং তার মধ্যে এমনও একটা গল্প লিখেছি... যেটা আমি দাবী করেছি, আমার নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া সত্যি অভিজ্ঞতা বলে। কিন্তু তারপরেও ওর কথায় অবিশ্বাস করায়, ও হয়তো একটু মর্মাহতই হয়েছিল। তবে আমার ওই প্রশ্নের খুব সুন্দর একটা উত্তর দিয়েছিল সায়নী। সেটা আমি এখানে তুলে ধরছি। ও আমায় বলেছিল...
- "আপনি একদম ঠিক কথাই বলেছেন। আমার এই ঘটনাগুলো যে শুনবে, সেই অবিশ্বাস করবে। ভাববে হয়তো আমি বানিয়ে বলছি, কিম্বা সবটাই আমার মনের ভুল ছিল। আর শুধু আপনি বলে না, আমাদের যিনি ইউথ আইকন... অর্থাৎ স্বামীজী, উনিও কিন্তু এই একই কথাই বলেছেন। নিজে চোখে না দেখে, নিজে কানে শুনে কোনো অলৌকিকত্বে বিশ্বাস করতে নেই। কিন্তু তারপরেও দেখুন, উনি কিন্তু ঠাকুরের দর্শন পেয়েছিলেন। অলৌকিকত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আর সেইজন্যই উনি নরেন্দ্রনাথ থেকে স্বামী বিবেকানন্দে পরিণত হয়েছিলেন।
আমিও ঠিক তাই। যতদিন না নিজে চোখে কিছু দেখেছি, নিজে কানে কিছু শুনেছি... ততোদিন অবধি এইসব অস্বাভাবিক ঘটনায় কখনও বিশ্বাস করিনি। কিন্তু ওই রাতের পর আমার চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণা সব কিছুই আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছিল। আমি বুঝতে শিখেছিলাম... একটা মানুষের মৃত্যুর পরেই সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়া নয়। মৃত্যুর পরেও তারা চাইলে আমাদের মাঝেই থাকতে পারেন। আর শুধু থাকাই নয়, তারা চাইলে ভয়ঙ্কর রকমের ক্ষতিও করতে পারেন। ঠিক যেমনটা হয়েছিল আমার বা আমার পরিবারের সাথে।"
সায়নী এরপর নিজের পরবর্তী দুদিনের ঘটনাগুলোও আমায় বলেছিল। সেগুলো শোনার পর অনেকেই হয়তো বিশ্বাস করবেন না ওর কথা। ভাববেন বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কথা বলেছে। কিন্তু আমি জানি... ও যা বলেছে সেগুলো মিথ্যা ছিলনা। আর এটা বোঝার একটা সহজ উপায়ও আছে। আপনারাও হয়তো চেষ্টা করলে বুঝতে পারবেন। আর সেই সহজ উপায়টা হল... আপনার অনুভূতি।
আসলে কোনো কল্পনা আশ্রিত গল্প, আর কোনো সত্যি ঘটনার মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয় এই অনুভূতি। যেটা নিয়ন্ত্রিত হয় আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে। ওর গল্পটা শুনতে শুনতে আপনার হঠাৎ করে গা ছমছম করে ওঠা, কিম্বা নিজের থেকেই সারা শরীরে শিহরণ খেলে যাওয়া... এইগুলোই আপনাকে বুঝিয়ে দেবে সায়নী মিথ্যা কথা বলছে না।
যাক, অনেক কিছুই বললাম। অনেক কিছুই বোঝালাম। এবার তাহলে ফিরে যাই সায়নীর কাছে। ওর মুখেই না হয় শুনে নিই, ওর বাকি দুদিনের পরবর্তী ঘটনাগুলো।
***************************************
পরেরদিন ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ঘুম ভেঙে গেছিল আমার। কেমন যেন একটা অস্বস্তি, একটা দুশ্চিন্তায় সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি আমি।
বারবার কিছু প্রশ্ন এসে আমার মনের ভিতরটা তোলপাড় দিচ্ছিল। যার উত্তরগুলো আমি হাজার খুঁজেও পাচ্ছিলাম না। বারবার মনে হচ্ছিল...
সুলেখাদি তো নিজের ইচ্ছাতেই আত্মহত্যা করেছিল। ওর সাথে তো আমরা কোনো খারাপ ব্যবহার করিনি। তাহলে ও কেন শুধু শুধু এসে আমাদের এইভাবে ভয় দেখাচ্ছে? কেন করছে এমন? কি চাইছে ও আমাদের কাছে থেকে?
তাছাড়া, আমি তো জানতাম মৃত্যুর পরে মানুষের সব দুঃখ কষ্টেরই অবসান হয়ে যায়। তাহলে ওর কেন হলনা? কিসের এতো ব্যথা... এতো কিসের যন্ত্রণা ওর মনে? সারারাত ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ওইভাবে... ও কেন কাঁদে?
উত্তরগুলো পেলাম সকালবেলায় ফোনে। আমার মায়ের কাছ থেকে। আসলে গতরাতের ওই ঘটনাগুলোর কথা কাউকে বলতে না পারলে, আমি ঠিক শান্তি পাচ্ছিলাম না। কিন্তু বলবো কাকে? বাড়িতে বয়স্ক শাশুড়ি আর টুকাই। তারমধ্যে শাশুড়ি এমনিতেই একটু ভয় পেয়ে রয়েছেন। ওনাকে বললে উনি আরও ভয় পেয়ে যাবেন, তাতে হীতে বিপরীত হবে। টুকাই তো বাচ্চা... ওর কথা বাদই দিলাম। রইলো বাকি অরিন্দম। ও এখন বাড়ি থেকে এতো দূরে রয়েছে, ওকে এইসব বলে ওর টেনশন বাড়াতে চাইছিলাম না আমি। তাই বাধ্য হয়েই সকাল সকাল মাকে ফোন করে সমস্ত ঘটনাগুলো বলেছিলাম।
সব কথা শোনার পর মা যা উত্তর দিয়েছিল, সেটা শুনে আমার পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেছিল। মা বলেছিল...
- "মানুষ যখন কোনো হতাশা, কোনো আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে আত্মহত্যা করে... তখন তার অতো সহজে মুক্তি হয়না। আর ওর তো এখনও শ্রাদ্ধের কাজও হয়নি।"
মা আরও বলেছিল...
- "এইসময়টা খুবই সাবধান থাকতে হয়। কারণ একটা মানুষ জীবিত কালে যার যতোটা প্রিয় হয়, মৃত্যুর পর তার ততোটাই শত্রু হয়ে যায়। আসলে সেই মৃত ব্যক্তি এই সময়টাতে চেষ্টা করে তার কাছের মানুষটাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার। তারজন্য সে যে কোনোরকম বেপরোয়া কাজ করতে পারে।"
মায়ের কথা শুনে প্রথমে আমার মনে হয়েছিল...
আমাদের বাড়িতে আবার সুলেখাদির কাছের মানুষ কে আছে? এই তো সবে দেড় মাসের পরিচয় ওদের সাথে।
কিন্তু তারপরেই হঠাৎ একজনের কথা মনে পড়লো আমার। আর সাথে সাথেই এক অজানা আশঙ্কায় বুকের ভিতরটা কেমন যেন খালি হয়ে গেল আমার!
সুলেখাদি কোন হতাশা, কোন আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নিজেকে এইভাবে জীবন্ত পুড়িয়ে মারলো... সেটা বুঝতে আর বাকি রইলোনা আমার।
কাঁপা কাঁপা গলায় মাকে জিজ্ঞেস করলাম...
- "এবার আমি কি করবো মা? অরিন্দমও এখানে নেই। টুকাইয়ের যদি কোনো বিপদ হয়। আমি সামলাবো কি করে?"
মা আমায় বলল...
- "তুই ভয় পাস না। দাঁড়া, তোর বাবার সাথে কথা বলি। অরিন্দম যতোদিন না আসে, আমি আর তোর বাবা না হয় তোর ওখানেই থেকে আসবো।"
মায়ের কথা শুনে মনটা এবার অনেকটাই যেন হালকা অনুভব হল আমার। এমনিতেই ওদের সাথে আমার দেখা হচ্ছিল না, তাও প্রায় অনেকদিন হয়ে গেল। শেষ দেখেছিলাম, এই ফ্ল্যাটে যখন গৃহপ্রবেশের পুজো করেছিলাম, তখন। তাও ওরা এসেছিল মাত্র আধবেলার জন্য। তারপর না আমি যেতে পেরেছি রিষরাতে, আর না ওরা এসেছে এখানে। তাই আজ যখন শুনলাম মা-বাবা এখানে এসে থাকবে দিন কয়েক, তখন হঠাৎ করেই ভয়ের রেশটা কেটে গিয়ে একটা খুশির আমেজে ভরে উঠল মনটা।
সেদিন সকাল সাড়ে নটা নাগাদ, বিল্ডিংয়ের নিচে সব্জিওয়ালা ভ্যান নিয়ে এল। ভাবলাম মা বাবা আসছে, এখান থেকে বেশি করে সব্জি কিনে রাখি। মাছ, মাংসটা না হয় যেদিনেরটা সেদিন কিনে আনলেই হবে। একটা ব্যাগ হাতে করে ফ্ল্যাটের দরজাটা টেনে দিয়ে নিচে চলে এলাম। নিচে তখন পাঁচতলার গৌরী বৌদি লিফটের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে দোতলার রুম্পাদির সাথে কথা বলছে। আমায় লিফট থেকে বেরোতে দেখেই, গৌরী বৌদি ডাক দিল...
- "সায়নী শোনো... তোমার সাথে কিছু কথা আছে।"
- "হ্যাঁ বৌদি বলো"
- "তোমরা তো চারতলাতেই থাকো, রাত বিরেতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না?"
কথাটা শুনেই চমকে উঠলাম আমি! তারমানে ওরাও নিশ্চয়ই কিছু অনুভব করতে পারছে। তবু না বোঝার ভান করে বললাম...
- "কিরকম অসুবিধা বৌদি?"
গৌরী বৌদি একবার একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ে চাপা গলায় বলল...
- "আমার তো পাঁচতলা থেকে নামতে গেলেই শরীরটা কেমন যেন ভারি হয়ে যাচ্ছে। নিজের থেকে সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। সারাক্ষণ মনে হচ্ছে ফাঁকা লিফটে কেউ আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তোমার হচ্ছে কিছু?"
আমি একটু ভেবে নিয়ে বললাম...
- "হ্যাঁ... আমারও ওরকম লাগছে মাঝে মাঝে। দুদিন আগে অরিন্দমও বলেছিল এই একইকথা। আমি তো ভেবেছিলাম, আমাদের রুমটা চারতলায় বলেই হয়তো আমাদের এরকম লাগছে। এখন তো শুনছি তোমাদেরও একই অবস্থা। আচ্ছা.. কি করা যায় বলো তো এটা নিয়ে?"
রুম্পাদি এবার একটু রাগ দেখিয়েই বলল...
- "কি আবার করবে? এখন ভোগো এইসব। মরার আর জায়গা পেলেন না উনি... বিল্ডিংয়ে এসেই মরতে হল। তারমধ্যে চেহারা খানা কি ছিল, দেখেছিলে তো। রাহুলের বাবা কাল বলছিল... ওনার নিশ্চয়ই সিংহ বা বৃষ এই জাতীয় কোনো ভারি রাশি ছিল। তাই পুরো বিল্ডিং জুড়েই এই অস্বস্তিটা হচ্ছে। ভারি রাশির লোকেরা আত্মহত্যা করে মরলে নাকি সেখানে এইরকম অসুবিধা টসুবিধা হয়।
যাক গে, আমার কি... আমি তো আজ ফুল ফ্যামিলি নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছি। যতোদিন না এইসব অলুক্ষুনে ব্যাপার পুরো ঠিক হচ্ছে, ততোদিন আর এ মুখোও হচ্ছি না।"
রুম্পাদির কথা শুনে গৌরী বৌদি বলল...
- "ওহ... তোমরাও আজ যাচ্ছো? আমরাও তো যাচ্ছি আজ বিকেলে। এমনিতেও অনেক দিন যাওয়া হচ্ছিল না, এই সুযোগে গিয়ে দিন কয়েক থেকে আসি বাবা।"
ওদের কথাবার্তা শুনে মনটা হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেল। তারমানে বিল্ডিং আজ অনেকটাই ফাঁকা হয়ে যাবে। এরমধ্যে আমি যদি কোনো বিপদে পড়ি, তাহলে তো চেঁচিয়েও লোক পাওয়া যাবে না। নিজেকে কেন জানি অসহায় বোধ হতে লাগল আমার। একবার মনে হল, বাবা-মাকে এখানে আসতে মানা করে দিই, তারচেয়ে আমিই বরং শাশুড়ি আর টুকাইকে নিয়ে রিষরায় চলে যাই। তারপর আবার মনে হল... এতোদিন বাদে নিজেরাই থাকতে আসতে চাইছে। মানা করাটা হয়তো ঠিক হবে না।
কি করবো আর কি না করবো ভাবতে ভাবতে আনমনে সব্জির ব্যাগটা নিয়ে লিফটে উঠলাম। দরজাটা বন্ধ হওয়া মাত্রই হঠাৎ মনে হল ফাঁকা লিফটে কেউ যেন আমার ঘাড়ের উপর এসে বসে গেল। কি প্রচণ্ড ওজন বেড়ে গেল শরীরটার... সে আমি বলে বোঝাতে পারবো না। আর সত্যি কথা বলতে কি, আমি যেন রীতিমতো অনুভবও করতে পারছিলাম... মারাত্মক ভারি চেহারার কেউ আমার গলার দুপাশে পা ঝুলিয়ে ঘাড়ের উপর বসে আছে। কোনোমতে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি।
লিফট চারতলা আসার পর, দরজা খুলে গেল। আমি সেখান থেকে বেরোতেই যাবো... এইবার আমি অনুভব করলাম কে যেন আমার কোমরটাকে চেপে ধরে আটকে রেখে দিয়েছে। আমি এগোতে চেয়েও এগোতে পারছি না। আর এতো স্পষ্ট সেই হাতের স্পর্শ... আমি যেন প্রত্যেকটা আঙ্গুল অনুভব করতে পারছিলাম নিজের কোমরে।
অরিন্দমের সেদিন রাতের কথাটা মনে পড়ে গেল আমার। ও কেন এত চিন্তিত ছিল, এইবার আমি বুঝতে পারলাম। অতি কষ্টে একপা দুপা করে ধীরে ধীরে বেড়িয়ে এলাম লিফট থেকে। তারপরে কোনোমতে নিজের রুমের দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই নিজেকে একটু হালকা মনে হতে লাগল আমার।
ঘড়িতে তখন সকাল দশটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। রান্নাঘরে ব্যাগ থেকে সব্জিগুলো নামিয়ে রাখতে রাখতে চিন্তা করছিলাম... ছেলেটাকে এখনও খাওয়ানো হয়নি। সেই কোন সকালে একটু কমপ্ল্যান দিয়ে দুটো বিস্কুট খেয়েছে। হয়তো খিদে পেয়ে গেছে ওর।
শাশুড়ি মায়ের টি.ভি থেকে কার্টুনের আওয়াজ ভেসে আসছে। আমার এই হয়েছে এক জ্বালা। সারাক্ষণ কার্টুনে ডুবে থাকে ছেলেটা। নাওয়া-খাওয়াটাও পর্যন্ত ভুলে যায় এই চক্করে। হঠাৎ টুকাইয়ের একটা মৃদু হাসির শব্দ পেলাম আমি। তবে শাশুড়ি মায়ের ঘর থেকে না। মনে হল আওয়াজটা এল হলরুমের পাশের বাথরুম থেকে।
টুকাই কি তবে টি.ভির রুমে নেই? সন্দেহবশতঃ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে উঁকি দিলাম শাশুড়ি মায়ের রুমে।
এ কি... ঘর তো খালি। টি.ভি চলছে টি.ভির মতো। কিন্তু টুকাই তো নেই এখানে। ও তো সচরাচর কার্টুন ছেড়ে উঠতে চায়না। তাহলে গেল কোথায় ও? শাশুড়ি মায়ের বাথরুম থেকে জলের আওয়াজ আসছে, তারমানে উনি স্নানে গেছেন। কিন্তু টুকাই কই গেল?
বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেমন যেন ছ্যাঁত করে উঠল আমার। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম হলরুমের বাথরুমটার দিকে। আবার আমার কানে এল টুকাইয়ের মৃদু হাসির শব্দ। তাড়াতাড়ি বাথরুমের ভিতর উঁকি দিতেই দেখলাম টুকাই সেখানে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
উফফফফ.... এতোক্ষন দমটা যেন আমার বুকের ভিতর আটকে ছিল। ওকে সুস্থ অবস্থায় দেখে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লাম আমি। তারপর একটু রাগী গলায় বললাম...
- "এখানে কি করছিস? নিশ্চয়ই আবার জল ঘাটছিলিস?"
ও হাসি মুখে আমায় বলল...
- "না মা... একটুও জল ঘাটিনি। দেখো.. দেখো.. আমার হাত ভেজা নেই।"
সত্যিই তো! ওর হাত তো একদম শুকনো। আমি এবার অবাক হয়ে বললাম...
- "তাহলে হাসছিলিস কেন?"
এর উত্তরে আমার সাড়ে পাঁচ বছরের বাচ্চাটা যা বলল, তাতে আমার পেটের ভিতরটা মোচড় দিয়ে সারা শরীরটা কেমন যেন থরথর করে কেঁপে উঠল। ও বলল...
- "আমি চিপস আন্টির সাথে খেলছিলাম তো!"
সেইমুহুর্তে ওখানে দাঁড়িয়ে আমি বুঝতে পারলাম। আমি এখন যেই ভয়াবহ বিপদের মধ্যে রয়েছি, তাতে দিন-রাত বলে কোনো কথা নেই। ও যে কোনো সময়, যে কোনো মুহুর্তে আসতে পারে আমাদের ঘরে। ওকে আটকানোর ক্ষমতা আমার হাতে নেই।
***************************************
সেদিন দুপুর একটা দেড়টা নাগাদ মা আর বাবা এল আমাদের বাড়িতে। ওরা আসার আগে অবধি নিজেকে যতোটা অসহায় বলে মনে হচ্ছিল, ওদের দেখার পর সেই ভাবটা অনেকটাই কেটে গেল আমার।
বিকেল চারটে অবধি বেশ ভালোই কাটলো তারপর। বহুদিন বাদে মা বাবাকে কাছে পেয়ে খাওয়া-দাওয়া আর জমিয়ে গল্প গুজব করতে করতে সময়টা যে কি করে কেটে গেল... টেরই পেলাম না আমি। কিন্তু অসুবিধাটা শুরু হল বিকেল চারটের পর।
টুকাই তখন শাশুড়ি মায়ের ঘরে ওনার বিছানায় ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ শাশুড়ি মা আমায় ডাক দিলেন। গিয়ে দেখি ছেলে আমার ঘুমের মধ্যেই থরথর করে কাঁপছে। আমি ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরতেই বুঝতে পারলাম, জ্বরে টুকাইয়ের গা একদম পুড়ে যাচ্ছে।
আমি তাড়াতাড়ি ওর গায়ে ব্ল্যাঙ্কেট চাপা দিলাম। ঘরে ওর জ্বরের ওষুধ P-250 ছিল, সেটাও খাইয়ে দিলাম। আমি বরাবর দেখেছি এই ওষুধটা খাওয়ানোর আধা ঘন্টার মধ্যে ঘাম দিয়ে ওর জ্বর অনেক নেমে যায়। কিন্তু সেদিন এক ঘন্টা হয়ে যাওয়ার পরও ওর না তো ঘাম দিচ্ছিল, আর না জ্বর নামছিল। তারমধ্যে ওকে আমি অনবরত জলপট্টিও দিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হচ্ছিল না। দুশ্চিন্তায় দুর্ভাবনায় আমার মাথা পাগল পাগল লাগছিল তখন। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কি করবো?
বাবা আমায় বলল...
- "এইভাবে রিস্ক নিয়ে বাড়িতে ফেলে রেখে কোনো লাভ নেই। তার চেয়ে এখানে কোনো চাইল্ড স্পেশালিষ্ট থাকলে, তার কাছে নিয়ে গেলে ভালো হয়।"
আমাদের বাড়ি থেকে মিনিট পনেরো দূরত্বে একজন চাইল্ড স্পেশালিষ্ট আছেন। আমি ফোন করে খোঁজ নিলাম... তিনি তখন চেম্বারেই ছিলেন। আমি আর বাবা টুকাইকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলাম সেই ডাক্তারের কাছে। মাকে বাড়িতে রেখে গেলাম যাতে শাশুড়ি মাকে একা বাড়িতে থাকতে না হয়।
ডাক্তারবাবু টুকাইকে দেখামাত্রই একটা ইঞ্জেকশন দিলেন। আর তার মিনিট পনেরো পর দেখলাম টুকাইয়ের জ্বরটা ধীরে ধীরে নামতে শুরু করলো। আমিও যেন এতোক্ষনে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। একটু আগে অবধি আমার মাথা যেন কাজ করা সম্পুর্ণই বন্ধ করে দিয়েছিল। এইবারে আমি একটু শান্ত হলাম।
প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে ডাক্তারবাবু আমায় জিজ্ঞেস করলেন...
- "ছেলের এতো জ্বর বাঁধলো কি করে? বৃষ্টি তে ভিজেছিল নাকি?"
সত্যিই তো! জ্বরটা কি করে এল সেটা তো আমিও জানি না। আমতা আমতা করে বললাম...
- "না তো ডাক্তার বাবু। বৃষ্টিতে তো ভেজেনি।"
উনি আবার গম্ভীর গলায় বললেন...
- "তবে...?"
এই তবে'র উত্তরটা তখন আমার কাছেও ছিল না। তাই চুপ করে ছিলাম। কিন্তু বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ করে দুটো কথা আমার মনে পড়লো।
একনম্বর হল, টুকাই বলেছিল... আমি তো চিপ্স আন্টির সাথে খেলছিলাম। আর দ্বিতীয় নম্বর, মা বলেছিল... মৃত ব্যক্তি এই সময় নিজের প্রিয় মানুষটাকে সাথে করে নিয়ে যেতে চায়।
কথাদুটো মনে আসতেই ওই ভীড়ে ভরা কলকাতার রাস্তার মধ্যেও আমার শরীর দিয়ে যেন একটা ঠাণ্ডা শিহরণ বয়ে গেল।
তাহলে কি সুলেখাদি সেই চেষ্টাই করছে?
আমার চোখের সামনে ওর মুখটা যেন ভেসে উঠল এবার। কপালের একদম উপরের দিকে একটা বড় লাল টিপ পরে, আর পানের জর্দায় দুটো ঠোঁট গাঢ় লাল করে সুলেখাদি যেন আমার দিকে তাকিয়ে খিকখিক করে হাসছে।
উফফফ... কি বীভৎস সেই হাসি। মনে পড়তেই আমার বুকের রক্ত যেন জল হয়ে গেল। আমি ভয়ের চোটে নিজের অজান্তেই নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে নিলাম।
টুকাইকে নিয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম, তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় সাতটা ছুঁই ছুঁই। বাবা আমাদের রুমে পৌঁছে দিয়ে বলল...
- "তোরা যা... আমি একটু আসছি নিচ থেকে।"
বাবাকে আমি মানা করতেই যাচ্ছিলাম যে রাত হয়ে গেছে, এখন আর নিচে যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু এই লোকটা কোনোদিনই কারো কথা শোনেনি, তাই বলেও কিছু লাভ হতো না। আমি টুকাই কে নিয়ে ঘরে ঢুকে এলাম।
ঘরে ঢুকেই দেখলাম, মা আর শাশুড়ি মা একঘরে বসে টি.ভিতে সিরিয়াল দেখছে। শাশুড়ি মা তো ঠিকঠাকই আছেন, কিন্তু মায়ের মুখটা দেখে কেমন যেন লাগল। মনে হল খুব যেন আতঙ্কে রয়েছে। আমি মা কে ডেকে পাশের ঘরে নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলাম...
- "কি হয়েছে তোমার?"
34
 © bnbooks.blogspot.com

Bnbooks is one of the largest archieve storage of pdf books, Bengali story, Bangla Kobita, Lyrics and all Kinds of Literature. Tags: Free Bangla pdf books download, Bangla Kobita, Technology News, Song Lyrics.