ও কেন কাঁদে - পর্ব ২ - ভৌতিক গল্প

ও কেন কাঁদে
লেখক: কল্যান সরকার
পর্ব

আমি রান্নাঘর থেকে একগ্লাস জল এনে অরিন্দমের হাতে দিয়ে, ওর পাশে বসলাম। তারপর ওর মাথাটা আমার কাঁধের উপর টেনে নিয়ে খুব ঠাণ্ডা গলায় বললাম...
- "আসলে তুমি পরশুদিন তো সারাক্ষন ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলে। তার উপর আবার আগুনে পোড়া ডেডবডিটাকেও ঘর থেকে বের করতে দেখেছ। তাই হয়তো তোমার মাথার মধ্যে এখনও সেগুলো ঘুরছে, আর সেইজন্যই আজ একা আসার সময় তোমার ওইসব ফিল হয়েছে। ওগুলো আর কিছুই না, জাস্ট মনের ভুল... অনেকের সাথেই এরকম হয়। তুমি যাও, জামাকাপড় ছেড়ে হাত-পা ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও... আমি চা বানিয়ে দিই.... চা খাও... দেখবে সব ভুলভাল চিন্তা মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে।"
অরিন্দম আরও কিছুক্ষন একমনে বসে কি যেন একটা ভাবলো, তারপর সোফা থেকে উঠে ধীরে ধীরে বাথরুমের দিকে চলে গেল।
ওর চোখমুখ দেখেই আমি বুঝতে পারছিলাম একটা চাপা ভয় তখনও ওর মধ্যে ভড় করে আছে।
তবে সত্যি কথা বলতে কি, এইসব ব্যাপারে আমার আবার ভয়ডর প্রায় নেই বললেই চলে। আমি প্রায়শই রাত জেগে ভূতের গল্প পড়ি, মোবাইলে ভূতের সিনেমা দেখি, এমনকি মাঝে মধ্যে রাতে ঘুম না এলে একা একা গিয়ে ব্যালকনিতেও দাঁড়িয়ে থাকি। কিন্তু আজ অবধি কোনোদিন কিছুতে ভয় পেয়েছি বলে আমার মনে পড়েনা।
সুলেখাদির মর্মান্তিক মৃত্যুটা আমার কাছে দুঃখজনক ছিল ঠিকই... কিন্তু তাই বলে ওর কথা চিন্তা করে আমি যে খুব ভয় পাচ্ছিলাম, তা কিন্তু মোটেই নয়। তবে নিজের সাহসিকতা নিয়ে আমার এই ভ্রান্ত ধারণা কাটতে খুব বেশি সময় লাগল না। আর সেটার সূত্রপাত হল সেইদিন রাতেই...
আমার ভালো করেই মনে আছে, সেইদিন রাতে লিফটে ওই ঘটনাটা হওয়ার পর অরিন্দম দরকার ছাড়া খুব বেশি কথা বলছিল না কারোর সাথে। ওকে দেখেই মনে হচ্ছিল ও যেন কোনো একটা দুশ্চিন্তায় ডুবে আছে। আমি বেশ কয়েকবার চেষ্টাও করেছিলাম ওকে নর্মাল করার। কিন্তু তাতেও খুব একটা ফল হয়নি। পরেরদিন অরিন্দমের পুণে যাওয়ার কথা ছিল, তাই নিয়েই ও বারবার আমায় বলে যাচ্ছিল...
- "বুঝতে পারছি না, কাল যাওয়াটা আদৌ ঠিক হবে কিনা!"
আমি একটু বিরক্ত হয়েই ওকে বলেছিলাম...
- "উফফফ্... তুমি চিন্তা করাটা বন্ধ করো তো এবার। বলছি তো আমি আছি, কোনো অসুবিধা হবে না। আর কোনো অসুবিধা হলে ভাইকে ফোন করে ডেকে নেব। ও না হয় কদিন এসে থেকে যাবে এখানে।"
আমার কথা শুনে অরিন্দম কতোটা নিশ্চিন্ত হতে পেরেছিল, তা জানি না। তবে ও আর এই ব্যাপারটা নিয়ে কোনো কথা বলেনি।
সেই রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা সবাই একটু আগেই শুয়ে পড়েছিলাম। টুকাই শুয়েছিল শাশুড়ি মায়ের ঘরে। ওনার নাকি একা শুতে গা-টা কেমন ছমছম করছিল।
অন্যদিন টুকাই শাশুড়ি মায়ের ঘরে শুলে, অরিন্দম সবসময় আমার সাথে মিলিত হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই রাতে দেখলাম ও ওইরকম কিছুই করল না। বিছানায় শোওয়া মাত্রই উল্টোদিকে ঘুরে ঘুমিয়ে গেল। ভাবলাম অফিসে হয়তো কাজের প্রেসার ছিল, তাই ক্লান্ত হয়ে আছে। আমিও ওকে আর জ্বালাতন করলাম না। মোবাইল ঘাটতে ঘাটতে কখন যে আমার চোখটাও বুজে এসেছিল, নিজেও জানিনা।
রাত তখন প্রায় সোওয়া একটা। হঠাৎ ঘুমের মধ্যে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে, ঘুমটা গেল ভেঙে। অনেককেই বলতে শুনেছি, পরিচিত মানুষ মারা গেলে নাকি রাতে স্বপ্নটপ্ন আসে। কিন্তু আজ অবধি আমার সেরকম কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি। তবে সেদিন রাতে কেন যে ওই স্বপ্ন দেখলাম....!!!!
আমি দেখলাম, সুলেখাদি ন্যাড়া মাথায় আমাদের সোফার উপর বসে টুকাইয়ের সাথে জোর করে ওর নতুন খেলনাগুলো দিয়ে খেলছে। টুকাই খেলতে চাইছে না, ও ভয় পেয়ে কাঁদছে। তাও সুলেখাদি ওকে ছাড়ছে না। কেমন যেন বিচ্ছিরি ভাবে হাসছে, আর ওকে চেপে ধরে রেখেছে। ঘুমের মধ্যেই আমি যেন শুনতে পারছিলাম... টুকাই চিৎকার করে মা.. মা.. বলে ডাকছে।
এরপরেই হঠাৎ করে ঘুমটা আমার ভেঙে গেল। বুঝতে পারলাম গলাটা শুকিয়ে এসেছে। অন্যদিন আমি খাটের পাশে জলের বোতল রেখে শুই। কিন্তু সেদিন কোনো কারণে রাখতে ভুলে গেছিলাম। আমি বিছানা থেকে উঠে রান্নাঘরে গেলাম জল আনতে। জলটা খেয়ে রান্নাঘরের আলো নিভিয়ে যখন আমি বেরোতে যাচ্ছি, ঠিক তখনই কেমন যেন একটা বিদঘুটে পোড়া পোড়া গন্ধ এসে লাগল আমার নাকে।
আশ্চর্য... এতো রাতে পোড়া গন্ধ! অবাক হয়ে গেলাম। আমি কি তাহলে গ্যাস নিভাতে ভুলে গেছি? আরও একবার রান্নাঘরের আলো জ্বালিয়ে সব কিছু ভালো করে দেখলাম।
নাঃ... সবই তো ঠিকই আছে। তাহলে এই গন্ধটা আসছে কোথা থেকে?
ঘরে তখন সবাই বেভুর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমি কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ হলরুমে এসে দাঁড়ালাম। এখান থেকে যেন উগ্র পোড়া গন্ধটার তীব্রতাটা আরও বেশি করে নাকে লাগছে। কিন্তু কোথা থেকে আসছে এই গন্ধ... আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। বেশ কিছুক্ষণ হতবুদ্ধির মত ওখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। তারপরেই হঠাৎ করেই আমার চোখ গেল, আমাদের ফ্ল্যাটের প্রধান দরজাটার দিকে।
কেমন যেন একটা অদ্ভুত সন্দেহ জাগল মনটার মধ্যে। আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম বন্ধ দরজাটার দিকে। তারপর আস্তে আস্তে দরজার ছিটকিনি খুলে, পাল্লাটা সামান্য ফাঁকা করলাম। আর সাথে সাথেই জীবনে প্রথমবার আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ের একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল।
হ্যাঁ... আমি যা সন্দেহ করেছিলাম, ঠিক তাই! গন্ধটা আসছে আমাদের রুমের বাইরের অন্ধকার বারান্দাটা থেকে।
কিন্তু এটা কি করে হতে পারে? একজন মানুষ তিনদিন আগে আগুনে পুড়ে মারা গেছে, তার সেই পোড়া গন্ধ তিনদিন পরে এই গভীর রাতে আমি কি করে পেতে পারি? এটা তো অসম্ভব ব্যাপার। নিজের ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে নিজেই যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলাম না আমি।
তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে, আমি সেখান থেকে বেডরুমে ফিরে এলাম। বিছানায় শুয়ে একবার মনে হল অরিন্দমকে ব্যাপারটা বলি। কিন্তু তারপর আবার মনে হল... ও এমনিতেই ভয় পেয়ে রয়েছে। এইসব কথা শুনলে আরও হয়তো ঘাবড়ে যেতে পারে। তাই ওকে আর ডাকাডাকি না করে, পাশে চুপচাপ ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। যদিও চোখে আমার ঘুমের লেশমাত্র ছিলনা তখন, তবুও জোর করে চোখ বুজে পড়ে রইলাম। শুনতে পারছিলাম আশেপাশেই কোথায় যেন একটা বিড়াল একদম মানুষের গলায় করুণ সুরে কেঁদেই চলেছে। রাতের অন্ধকারে খুবই অস্বস্তি লাগছিল সেই ডাকটা শুনে। কিন্তু সেইমুহুর্তে বিছানা ছেড়ে উঠে বিড়ালটাকে তাড়ানোর সাহস আমার ছিল না। তাই কানের উপর বালিশ চাপা দিয়ে অরিন্দমকে চেপে ধরে শুয়ে রইলাম।
***************************************
সেই রাতে কখন যে আমার ঘুম এসেছিল, আমি নিজেই জানি না। তবে এইটুকু মনে আছে পরেরদিন সকালে উঠতে আমার বেশ দেরীই হয়ে গেছিল।
ওইদিন আবার অরিন্দমের পুণে যাওয়ার তারিখ। বিকেল চারটেয় দমদম থেকে ফ্লাইট। ও দুপুর দেড়টার মধ্যে বেড়িয়ে যাবে বাড়ি থেকে। তাই সেদিন সকালে কাজের বেশ চাপ ছিল আমার। ও কি কি নিয়ে যাবে, সেগুলো বের করে দেওয়া, তাড়াতাড়ি রান্না করা, ঘর গোছানো, স্নান করে ঠাকুরকে পুজো দেওয়া.. এইসব কর্মব্যস্ততার মাঝে গতরাতের ঘটনাগুলো মাথা থেকে প্রায় বেরিয়েই গেছিল আমার। তবে মাঝে মাঝে যখন কোনো দরকারে নিজের ঘরের দরজা খুলছিলাম, আর ৩০৩ নম্বর রুমটার দিকে চোখ পড়ছিল... তখন কয়েকবার মাথায় এসেছিল আগের রাতের কথাগুলো। কিন্তু দিনের আলোয়, তখন গতরাতের ওই সম্পুর্ণ ব্যাপারটাকেই আমার মনের ভুল বলেই মনে হয়েছিল।
সেদিন দুপুরবেলায় অরিন্দম যখন বেরোচ্ছে.. তখনই আকাশ কালো করে ছিল। আর ও যাওয়ার আধা ঘন্টার মধ্যেই ঝেঁপে বৃষ্টিটাও চলে এল। আমরা তিনজন দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে একটু শুয়ে ছিলাম। এমনিতে আমার দুপুরে ঘুমানোর অভ্যেস নেই। কিন্তু গতরাতে ঘুমটা ঠিকমতো হয়নি তাই, কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
চোখ যখন খুললাম, তখন চারিদিকে অন্ধকার হয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। মোবাইলে সময় দেখে বেশ অবাকই হলাম। প্রায় তিন ঘন্টারও বেশি সময় ধরে ঘুমিয়েছি আমি। মনে মনে ভাবলাম, আজ রাতের ঘুমটা গেল আমার। তবে একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হলাম যে অরিন্দম আজ বাড়িতে নেই। তাই রাতে দেরি করে ঘুম আসলেও, কাল সকালে ওঠার অতো তাড়া নেই।
সন্ধ্যে পৌনে সাতটা নাগাদ চা বানিয়ে শাশুড়ি মাকে যখন দিতে গেলাম, উনি একটা অদ্ভুত কথা বললেন...
- "কি হয়েছে সায়নী? বাড়ির কারো সাথে ঝগড়া হয়েছে বুঝি?"
আমি অবাক হয়ে বললাম...
- "ঝগড়া!!! কই নাতো!"
- "তাহলে একটু আগে বাথরুমে ঢুকে গুমড়ে গুমড়ে ওইভাবে কাঁদছিলে কেন?"
- "বাথরুম..??? আমি...???" কথাটা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম।
- "কই আমি তো বাথরুমে যাইনি মা। আমি তো রান্নাঘরে চা বানাচ্ছিলাম।"
শাশুড়ি মায়ের মুখ দেখে মনে হল, উনি যেন আমার কথাটা বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না। উনি নিজের মনেই বিড়বিড় করে বললেন...
- "তুমি বাথরুমে যাওনি!!! কিন্তু আমি যে পরিষ্কার শুনলাম......"
হঠাৎ আমার মনে এল গতরাতের সেই বিড়ালের কান্নার আওয়াজটার কথা। আমি একটু হেসে উঠে বললাম...
- "ওহ... বুঝেছি। আপনি হয়তো সেই বিড়ালের কান্নার আওয়াজটা পেয়েছেন। কাল রাতে আমিও পেয়েছি সেই আওয়াজ।"
- "বিড়ালের কান্না???" শাশুড়ি মায়ের বিস্ময় যেন আরও বেড়ে গেল।
- "আর বলবেন না মা। কে জানে কোথা থেকে এই আপদটা এসে জুটেছে। হয়তো সিঁড়ি বা দরজার সামনে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। তারপর সারাক্ষণ ওই মরাকান্না কাঁদতে থাকে। দাঁড়ান.. কালকেই দারোয়ানকে বলে ওটাকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।"
আমার কথা শুনে শাশুড়ি মা আর বিশেষ কিছু বললেন না বটে। তবে ওনার চোখ মুখ দেখে মনে হল, উনি হয়তো কথাটা ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারলেন না।
সেদিন রাত নটা, সোওয়া নটা নাগাদ অরিন্দমের ফোন এল। ও হোটেলে পৌঁছে গেছে, কোনোরকম অসুবিধা হয়নি ওর। অরিন্দমের ফোনটা রেখেই রাতের রুটি করতে যাবো বলে কিচেনের দিকে পা বাড়াচ্ছিলাম, হঠাৎ আমার নজর পড়ল হলরুমের সাদা মার্বেলের উপর।
আশ্চর্য... এখানে এরকম চুল এল কোথা থেকে? সারা হলরুমের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মানুষের মাথার এক বিঘত সাইজের কাটা চুল। সেগুলো আবার ফ্যানের হাওয়ায় এদিক সেদিক উড়ছে। দেখেই খুব রাগ হল শাশুড়ি মায়ের উপর। ওনার এরকম অভ্যাস আছে কাঁচি দিয়ে চুল কাটার। আগা ফেটে গেলেই নিজের চুল নিজে কেটে নেন। আজও নিশ্চয়ই তাই করেছেন। মনে মনে ওনার উপর রাগ করলেও, মুখে কিছু বললাম না। শুধু চুলগুলোকে ঝাঁটা দিয়ে জড়ো করে ডাস্টবিনে ফেলে, তারপর আবার গেলাম রুটি করতে।
তবে সেদিন একটা ব্যাপার আমি খেয়াল করতে পারিনি, যদি পারতাম তাহলে হয়তো মিছিমিছি শাশুড়ি মায়ের উপর রাগ করতাম না। আর সেই ব্যাপারটা হল... শাশুড়ি মা যখন চুল কাটেন, তখন কাঁচা পাকা চুল মেশানো থাকে। কিন্তু সেইদিন আমার মার্বেলে শুধু... কাঁচা চুলই ছিল!!!
ওইদিন রাত দশটার পর আবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হল। অন্যসময় অরিন্দম বাড়িতে থাকলে, আমাদের খেতে খেতে রাত এগারোটা, সাড়ে এগারোটা বেজে যায়। কিন্তু সেদিন কোনো কাজ না থাকায় আমরা সাড়ে দশটার মধ্যেই সবাই খেয়ে নিয়েছিলাম। শাশুড়ি মা বললেন, ওনার আজও নাকি একা শুতে অসুবিধা হচ্ছে। তাই তিনজনেই এক ঘরে শুয়ে পড়তে। তাই শুনে আমি বললাম...
- "ঠিক আছে মা... আপনি না হয় টুকাইকে নিয়েই শুয়ে পড়ুন। আমার একা শুতে কোনো অসুবিধা হবেনা।"
উনি কেমন যেন চিন্তিত গলায় বললেন...
- "পারবে তুমি একা শুতে?"
আমি মৃদু হেসে বললাম...
- "হ্যাঁ... হ্যাঁ... কেন পারবো না? আগে নিজের বাড়িতেও তো একাই শুতাম।"
শাশুড়ি মা আর কোনো কথা বাড়ালেন না। শুধু টুকাইকে নিয়ে নিজের ঘরে যেতে যেতে বলে গেলেন...
- "ঠিক আছে... দরজাটা ভেজানো রইলো তাহলে। অসুবিধা হলে ডাক দিও।"
আমিও ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম। আসলে সত্যি কথা বলতে টুকাই ওই ঘরে শোওয়ায় মনে মনে আমি একটু খুশিই হয়েছিলাম। কারণ দুপুরে এমনিতেই আজ অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি, রাতে ঘুম আসতে দেরি হবে। তার উপর কাল অরিন্দমের অফিসের তাড়াও নেই। তাই আরামসে একটা ওয়েব সিরিজ দেখা হয়ে যাবে। টুকাই সামনে থাকলে মোবাইলে কিছু দেখাই যায়না। খুব জ্বালাতন করে।
যেই ভাবা সেই কাজ। রাত পৌনে এগারোটা নাগাদ আশ্রমের এর সিজন-২ টা চালিয়ে বিছানায় শুলাম। অনেকদিন ধরে এটা দেখার শখ ছিল। বাইরে তখনও একনাগাড়ে বৃষ্টি পড়ে চলেছে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ওয়েদারে শুয়ে শুয়ে মুভিটা দেখতে বেশ ভালোই লাগছিল।
কটা বাজে তখন... বারোটা, সোওয়া বারোটা হবে। সবে তিনটে কি চারটে এপিসোড শেষ করেছি। হঠাৎ আমার পেটটা মোচড় দিয়ে পিরিয়ড হয়ে গেল। রাত বিরেতে এইরকম পিরিয়ড হলে আমার খুব রাগ হয়। কিন্তু কি আর করা যাবে?
মোবাইলটা বন্ধ করে প্যাডটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম। আর সাথে সাথেই একটা বুক কাঁপিয়ে দেওয়া অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হলাম আমি। হয়তো আপনাদের বললে, আপনারা কেউ বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু সেদিন বাথরুমের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করা মাত্রই আমি শুনতে পেলাম... একজন মহিলা যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে বাথরুমের ভিতরে। কিন্তু সেই সময় আমি ছাড়া বাথরুমের ভিতর আর কেউ ছিল না।
তাহলে কান্নার আওয়াজ আসছে কোথা থেকে? ভয়ানক চমকে গিয়ে তাড়াতাড়ি বাথরুম থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি।
কই না তো! কোনোই তো আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। তাহলে কি আমার শুনতে কোনো ভুল হয়েছে?
আবার সাহস করে বাথরুমের ভিতর ঢুকলাম আমি। তারপর দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করলাম। ব্যাস... সাথে সাথেই আবার সেই কান্নার আওয়াজটা শুরু হয়ে গেল। মনে হল কেউ যেন একদম আমার পাশে দাঁড়িয়ে, গায়ে গা ঠেকিয়ে কাঁদছে। আর এই গলার আওয়াজটা আমার খুব চেনা। শরীরটা কেমন যেন ভারি হয়ে এল আমার। গলাটা নিজের থেকেই শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। আমি আর একমুহুর্তও ওখানে না দাঁড়িয়ে, তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বাইরে এসে হলরুমে দাঁড়ালাম।
বুকের ভিতরটা তখনও ঢিপঢিপ করছে আমার। একবার মনে হল ওখানে দাঁড়িয়েই প্যাডটা পরে নিই... কেই বা দেখতে যাবে?
কিন্তু তার পরক্ষনেই মনে হল... কিসের ভয়ে আমি বাথরুমে যাচ্ছি না? এরকম আবার কখনও হয় নাকি যে ফাঁকা বাথরুমে কেউ কাঁদবে? নিশ্চয়ই আমার বুঝতে কোথাও ভুল হচ্ছে। হয়তো সেই বিড়ালটাই আবার কাঁদছে, আর আমি ভাবছি বাথরুমে কেউ রয়েছে।
নিজের মনকে আগের থেকে অনেকটা সাহস জুগিয়ে আবার আমি এগিয়ে গেলাম বাথরুমের দিকে। মনে মনে ঠিক করলাম, যেই আওয়াজই হোক না কেন.. নিজের কাজ শেষ করে তবে এইবার বাথরুম থেকে বেরোবো।
কিন্তু আমার সমস্ত সাহস, সব আত্মবিশ্বাস.. সকল কিছুই এক লহমায় শেষ হয়ে গেল, যখন আমি বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করলাম। আবার সেই একই ভাবে কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদছে। আর এইবার তার সাথে অনুভব করলাম আওয়াজটা ক্রমশ যেন আমার দিকেই এগিয়ে আসছে।
কাছে... আরও কাছে... আরও আরও কাছে... একদম আমার কানের সামনে।
কিছুতেই নিজেকে আর শক্ত রাখতে পারলাম না আমি। অনুভব করলাম আমার সারা দেহের ওজন যেন কয়েকগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। তার সাথে হাত-পাগুলোও কেমন যেন অবশ হয়ে গেছে। নড়াচড়া করার শক্তিটুকুও আমি যেন আর পাচ্ছিলাম না...
ঠিক ওইরকম একটা অবস্থায়, হঠাৎ আমার চোখ গেল বাথরুমের কমোডের একদম নিচ দিকটায়। ওখানে জড়ো হয়ে পড়ে আছে মানুষের মাথার এক বিঘত সাইজের কুচানো চুল। এইবার আর বুঝতে অসুবিধা হল না যে... এই চুল আমার শাশুড়ির না। এই চুল হল তার, যে কিনা জেদে, রাগে, তেজে পাগল হয়ে গিয়ে নিজের মাথার চুল নিজে কেটে ন্যাড়া হয়েছিল।
অর্থাৎ, সুলেখাদির চুল...
ওর নামটা মাথায় আসা মাত্রই ওই বন্ধ বাথরুমের ভিতর আমি যেন ওর পারফিউমের গন্ধটাও অনুভব করতে পারলাম।
এরপর সেদিন আমি কি ভাবে যে ওই বাথরুমের খুলে শাশুড়ি মায়ের ঘরে ছুটে গেছিলাম, তা শুধু আমিই জানি।
শাশুড়ি মা আমার আওয়াজ পেয়ে ঘুম থেকে জেগে গিয়ে আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন... আমি ভয় পেয়েছি কিনা?
আমি নিজেকে খুব শান্ত করে নিয়ে বলেছিলাম...
- "না.. না.. আসলে অনেকদিন একা শুই না তো, তাই ঘুম আসছিল না।"
তারপর শাশুড়ি মায়ের ছোটো অ্যাটাচ বাথরুমটায় নিজেকে ফ্রেশ করে, সেইরাতে আমি ওই ঘরেই শুয়েছিলাম।
কিন্তু শোওয়ার পরেও, অনেক রাত অবধি আমি সেইদিন ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজটা পেয়েছিলাম। বুঝে গেছিলাম, এটা কোনো বিড়ালের আওয়াজ নয়... এটা কোনো মানুষের আওয়াজ... কিম্বা আরও ভালো করে বললে, এটা হয়তো কোনো জীবিত মানুষেরও আওয়াজ নয়....
© bnbooks.blogspot.com

Bnbooks is one of the largest archieve storage of pdf books, Bengali story, Bangla Kobita, Lyrics and all Kinds of Literature. Tags: Free Bangla pdf books download, Bangla Kobita, Technology News, Song Lyrics.