ও কেন কাঁদে - পর্ব ১ - ভৌতিক গল্প

ও কেন কাঁদে
লেখক: কল্যান সরকার
পর্ব ১



- "স্যার, আপনার কাছে ফকির বাবার ঠিকানাটা পাওয়া যাবে?"
বেশ অবাক হলাম ওনার কথাটা শুনে। হঠাৎ ফকির বাবার ঠিকানা কেন?
যদিও ফকির বাবার সাথে আমার নিজস্ব কোনো পরিচয় নেই। তবে এইটুকু জানতাম উনি একজন মুসলমান তান্ত্রিক। মানুষের বিপদ-আপদে সাহায্য করে থাকেন। বিশেষতঃ যেই বিপদগুলো ঠিক সুস্থ স্বাভাবিক না.. যার মধ্যে লুকিয়ে আছে কোনো অলৌকিক বা অস্বাভাবিক কারন, তার থেকে তিনি বহু মানুষকে উদ্ধার করেছেন। তাই লোকে ওনাকে মানেন, এবং বিশ্বাস করেন। ফকির বাবার এই অদ্ভুত ক্ষমতার কথা আমি আমার পুরোনো একটা গল্পে উল্লেখ করেছিলাম। আমার মনে হল তার থেকেই হয়তো, আমার এই পাঠিকার মনে ওনার প্রতি বিশ্বাস জন্মেছে।
কিন্তু প্রশ্ন তবু থেকেই গেল... কি এমন ঘটছে ওনার সাথে যে হঠাৎ করে ফকির বাবার ঠিকানা প্রয়োজন হয়ে পড়লো? কথাটা জিজ্ঞেস করতেই উনি আমাকে যা বললেন... তা শোনার পর দিনে দুপুরেও আমার শিরা-উপশিরা দিয়ে একটা ভয়ের শিহরণ খেলে গেল।
নমস্কার... আমার নাম সায়নী ঘোষ সরকার। আমি একজন তিরিশোর্দ্ধ বিবাহিতা মহিলা, এবং এক সন্তানের মা। আমার বাপের বাড়ি রিষরাতে, আর বিয়ে হয়েছে আগরপাড়ায়। তবে বর্তমানে এখন আর আমরা আগরপাড়ার বাড়িতে থাকিনা। জায়গা জমি নিয়ে কিছু শরিকি ঝামেলার কারণে বিয়ের তিন বছর পরই আমরা শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে বরানগরের একটা ভাড়া বাড়িতে এসে উঠেছিলাম। তারপর সেখানে আবার বছর তিনেক থাকার পর, দেড়মাস আগে জোকাতে নিজেদের একটা 2BHK ফ্ল্যাট কিনে, সেখানে চলে আসি আমরা। এখানে 'আমরা' বলতে... আমি, আমার স্বামী অরিন্দম সরকার, শাশুড়ি মা মধুছন্দা সরকার, আর আমাদের পাঁচ বছরের ছেলে টুকাই এর কথা বলেছি।
অরিন্দম এইমুহুর্তে একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে ম্যানেজার পদে চাকরি করে। আর আমার শ্বশুর মশাই যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ছিলেন তাই শাশুড়ি মা এখনও পেনশন পান। মোটের উপর আমাদের চারজনের সংসার বেশ ভালোভাবেই চলে যায়। অসুবিধা, ঝুট-ঝামেলা সেরকম কোনোদিনই কিছু একটা ছিলনা। কিন্তু আমাদের মতো এই নির্ঝঞ্ঝাট পরিবারেও যে হঠাৎ করে এমন একটা বিপদ নেমে আসবে, তার ধারণা আমার কোনোদিনই ছিলনা।
তবে সেই ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলার আগে আরও একটা কথা জানিয়ে রাখা দরকার, তা হল... আমাদের ফ্ল্যাটের অবস্থানটা আমি জোকা বললেও, সেটা কিন্তু ঠিক প্রপার জোকাতে নয়। বরং জোকা থেকে কিছুটা ভিতরের দিকেই। আসলে আগে আমরা যেই বাড়িটায় ভাড়া থাকতাম, তার বাড়িওয়ালা বেশ কিছুদিন ধরেই রেনোভেশনের জন্য আমাদের ঘরটা খালি করতে বলছিলেন। এইজন্য তাড়াতাড়ি আমাদের একটা অন্য বাড়ির দরকার ছিল। কিন্তু অরিন্দমের আবার ইচ্ছা ছিল, এই বাড়ি ছাড়ার পর ও আর অন্য কোথাও ভাড়া যাবেনা। তাই বেশ কয়েক মাস ধরেই কলকাতার দিকে নতুন ফ্ল্যাটের সন্ধানও করছিলাম আমরা। কিন্তু বাজেটের মধ্যে সেরকম পছন্দসই কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না। প্রপার সিটিতে যাও বা দু-একটা ভালো লাগছিল, কিন্তু সেগুলোর দাম সব আকাশ ছোঁয়া। এইরকম একটা সময় অরিন্দমের একজন অফিস কলিগ আমাদের এই ফ্ল্যাটটার খোঁজ দিল। প্রথমবার দেখতে এসেই আমার বেশ মনে ধরে গেল এই জায়গাটা। যদিও একটু ভিতরে, কিন্তু চারপাশের খোলামেলা শান্তশিষ্ট পরিবেশ দেখে খুব পছন্দ হয়ে গেল আমার। তারমধ্যে এটার দামটাও ছিল সাধ্যের মধ্যে।
আমরা যেদিন বুকিং করতে এসেছিলাম, সেদিনই কথা বলে নিয়েছিলাম... ফ্ল্যাট আমাদের খুব তাড়াতাড়ি চাই। প্রোমোটার মানুষটি দেখলাম বেশ ভালো। উনি কথা দিয়েছিলেন, আমাদের ঘরটাই উনি সবার আগে কমপ্লিট করে দেবেন। আর দিয়েও ছিলেন তাই। আমাদের এই G+7 শান্তিনীড় বিল্ডিংয়ের টোটাল ২১টা ঘরের মধ্যে আমরাই সবার প্রথম গৃহপ্রবেশ করে এখানে ঢুকেছিলাম।
এরপর দেখতে দেখতে কেটে গেল প্রায় দেড়মাস সময়। তারমধ্যে আরও গোটা ছয়েক ফ্যামিলি চলে এল তাদের নিজেদের ফ্ল্যাটে। শান্তিনীড় ধীরে ধীরে মানুষের কোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠতে শুরু করলো।
আমাদের ফ্ল্যাটটা বিল্ডিংয়ের চারতলায়। নাম্বার ৩০১। অন্যান্য ফ্লোরে লোক চলে এলেও আমাদের এই ফ্লোরটায় এখনও কেউ আসেনি। অর্থাৎ ৩০২ আর ৩০৩ নম্বরটা খালিই পড়ে আছে। তারমধ্যে ৩০৩ নম্বরের যেই ঘরটা, সেটা আবার একদমই আমার ঘরের মুখোমুখি। ওই ফ্ল্যাটের যারা মালিক, অর্থাৎ অতনুদা আর সুলেখাদি... ওনারা বেশ কয়েকবার এসেছিলেন নিজেদের ঘরটা দেখার জন্য। আমাদের সাথে ভালো পরিচয়ও হয়ে গেছিল ওনাদের। যতবারই ফ্ল্যাট দেখতে আসতেন, একবার অন্তত আমাদের ঘরে ঢুঁ দিয়ে যেতেন। কখনও আবার হাতে সময় থাকলে, বসে গল্প করে চাও খেয়ে যেতেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বেশ মিশুকে লোক। তবে সুলেখাদির তুলনায় অতনুদা একটু কমই কথা বলতেন।
অতনুদা লোকটার বয়স চল্লিশ বিয়াল্লিশ হবে। রোগা-পাতলা চেহারা, মাথায় হালকা টাক। এক নজরে দেখলে শান্তশিষ্ট, নিপাট গোবেচারা টাইপের ভদ্রলোক মনে হয়। সুলেখাদি আবার ছিল ওনার ঠিক উল্টো। লম্বা-চওড়া, রাশভারী চেহারার একজন মহিলা। বয়স সাঁইত্রিশ আটত্রিশের বেশি হবেনা। কপালের একদম উপরের দিকে একটা লাল রঙের সিঁদুরের টিপ পরতো, আর ঠোঁটদুটো সবসময় পান খাওয়ার কারনে লাল হয়ে থাকতো। ওকে দেখলেই কেমন যেন আগেকার দিনের জমিদার গিন্নীগুলোর কথা মনে আসতো।
আমার এখনও মনে আছে, অরিন্দম একবার অতনুদাকে সিগারেট অফার করেছিল। উনি হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়েও নিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরেই সুলেখাদি এমনভাবে ওনার দিকে চোখ কটমট করে তাকালো, যে বেচারা ভয়ে ভয়ে সিগারেটটাই ফিরিয়ে দিয়ে বললেন..
- "নাঃ থাক... একটু আগেই খেয়ে এসেছি। এখন আর খাবোনা। ডাক্তার বেশি স্মোকিং করতে মানা করেছে।"
এই নিয়ে আমি আবার রাতে অরিন্দমকে বলেছিলাম...
- "দেখলে তো অতনুদা সুলেখাদিকে কতোটা ভালোবাসে। তাকানো মাত্রই সিগারেটটা ফিরিয়ে দিল। আর তুমি তো আমার বারণ শুনতেই চাওনা।"
আমার এই কথায় অরিন্দম হেসে বলেছিল...
- "ভালোবাসে না হাতি... অশান্তির ভয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিল। কিছুই কি বুঝিনা ভেবেছ? আসলে তোমার এই অতনুদা রীতিমতো ডরিয়ে চলে নিজের বউকে। এমনিতেই মহিলার যা দশাসই চেহারা, দেখলে আমারই কেমন ভয় ভয় লাগে।"
তবে সুলেখাদিকে নিয়ে অরিন্দম মজা করে যাই বলুকনা কেন, একটা ব্যাপার কিন্তু অস্বীকার করার জায়গা নেই। তা হল সুলেখাদির চেহারা রাগী রাগী হলেও, ওর কথাবার্তা, ব্যবহার, কিম্বা স্বভাব সত্যিই খুব ভালো ছিল। আজ অবধি কখনওই আমাদের বাড়িতে ও খালি হাতে আসেনি। সবসময়ই কিছু না কিছু সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। বিশেষ করে টুকাইয়ের জন্য চিপস আর ক্যাডবেরি তো বাঁধাধরাই ছিল। ওকে দেখলেই টুকাই বলত... চিপস আন্টি এসে গেছে। আর সুলেখাদিও যে টুকাইকে খুব ভালোবাসতো, সেটা ওর চোখমুখ দেখেই বোঝা যেত।
অবশ্য এই অপত্য স্নেহর পিছনে অন্য একটা কারণ থাকাও খুব স্বাভাবিক। আর সেটা হল, সুলেখাদি ছিল নিঃসন্তান। বিয়ের পর বারো বছর কেটে যাওয়ার পরেও ও মা হতে পারেনি। ওর নাকি ওভারিতে কিছু একটা প্রবলেম থাকায় ডাক্তার ওকে অনেক আগেই বলে দিয়েছিল... সন্তান জন্ম দেওয়ায় ওর মুশকিল আছে। আর সেই জন্যই হয়তো আমাদের বাড়িতে এসে টুকাইকে দেখে ওর মনে মাতৃত্বের মমতাটা জেগে উঠেছিল। তবে কারণ যাই হোক, সুলেখাদি আর টুকাই যে একে অপরকে সত্যিই খুব ভালোবাসতো... এই ব্যাপারে আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। আর আমিও এই নিয়ে ওদের কোনোদিন কোনোরকম বাঁধা দিইনি। বরং আমার শাশুড়ি মা আমাকে বেশ কয়েকবার বলেছিলেন...
- "ব্যাপারটা কিন্তু এবার বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে সায়নী। সুলেখা যখনই আসে, তখনই ওরকম টুকাই টুকাই কেন করতে থাকে?"
আমি তাতে হেসে বলেছিলাম...
- "থাক না মা! এতে অসুবিধার কি আছে? বাচ্চা দেখলে অনেকেরই ওরকম হয়।"
আসলে আমার মনে হতো একজন নিঃসন্তান মহিলা যদি আমার ছেলের সাথে কথা বলে, ওকে আদর করে সাময়িক মাতৃত্বের স্বাদ নিতে চাইছে, তাহলে নিক না। এতে ক্ষতির তো কিছু নেই।
যাই হোক, শান্তিনীড়ে আসার পর এইভাবেই কেটে যাচ্ছিল আমাদের দিনগুলো। নিজেদের নতুন বাড়িতে এসে সবাই বেশ খুশিতেই ছিলাম। এরমধ্যে অরিন্দমের অফিস থেকে ওকে দিন সাতেকের জন্য একটা ট্রেনিংয়ে পুণে পাঠানোর কথা হল। সেটা করে আসতে পারলে ওর প্রোমোশনও হওয়ার কথা। ও অবশ্য অফিসে 'হ্যাঁ' বলার আগে আমায় জিজ্ঞেস করেছিল... নতুন জায়গায় আমরা তিনজন একা থাকতে পারবো কিনা? আমি তাতে ওকে বলেছিলাম...
- "কেন পারবো না? এখন তো বিল্ডিংয়ে অনেক ফ্যামিলি এসে গেছে। তাছাড়া গেটের সামনে দারোয়ান তো সারাক্ষণই থাকে। তুমি নিশ্চিন্তে যাও। মাত্র সাত দিনের ব্যাপার। ও আমি ঠিক সামলে নেবোখন।"
এরপরে অরিন্দম আর কোনো দ্বিমত করেনি। অফিসে জানিয়ে দিয়েছিল ও ট্রেনিংয়ে যেতে রাজি। কিন্তু অরিন্দমের যাওয়ার যখন আর মাত্র দিন চারেক মতো বাকি, ঠিক তখনই আমাদের বিল্ডিংয়ে এমন এক ঘটনা ঘটলো যা আমার এতোদিনের চিন্তাভাবনা, আত্মবিশ্বাস, সবকিছুই এক লহমায় নষ্ট করে দিল।
আমার আজও মনে আছে... সেইদিনটা ছিল রবিবার। অরিন্দমের অফিস ছুটি, তাই ও সেলুনে গেছিল চুলদাড়ি কাটাতে। আমি আপন মনে রান্নাঘরে রান্না করছিলাম। হঠাৎ আমাদের ঘরের কলিং বেলের আওয়াজটা আমার কানে এল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম... সকাল এগারোটা কুড়ি বাজে। মনে মনে বেশ আশ্চর্য হলাম!
এই সময় আবার কে এল? এখন তো কারো আসার কথা নয়। তাছাড়া অরিন্দম তো এই কিছুক্ষণ আগেই গেল, তাহলে কি ও আবার ফিরে এল?
কথাগুলো মনে মনে ভাবছি, ততোক্ষণে আরও দুবার বেলের আওয়াজটা হল। ব্যস্ত হয়ে দ্রুত পায়ে গিয়ে দরজাটা খুলতেই চোখে পড়ল... দরজার সামনে হাতে একটা বড় ব্যাগ নিয়ে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে সুলেখাদি। ওকে হঠাৎ এইরকম একটা সময়ে আসতে দেখে আমি বেশ অবাকই হলাম। ওরা সাধারণত দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর কিম্বা বিকেলের দিকেই এখানে আসে। কিন্তু আজ কেন সকালের দিকে এল, তা বুঝে উঠতে পারলাম না। তাছাড়া অন্য দিনের তুলনায় আজ ওর সাজগোজটাও যেন একদম আলাদাই ছিল। পরনে লাল বেনারসি শাড়ি, মুখে চড়া মেককাপ, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক, চোখে আই-লাইনার, এমনকি মাথায় একটা চন্দ্রমল্লিকা ফুলও গোঁজা। দেখে মনে হল হয়তো কোনো বিয়ে বাড়িতে যাবে।
আমি দরজার বাইরে সামান্য উঁকি দিয়ে বললাম...
- "অতনুদা আসেনি?"
সুলেখাদি ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে হাসি মুখে বলল...
- "কেন... আমার বুঝি একা আসতে নেই? নাকি একা আসলে ঢুকতে দেবে না?"
কথাটা শুনে আমি একটু লজ্জায় পড়ে গেলাম। কোনোমতে সামলে নিয়ে বললাম...
- "ছি ছি... তা কেন হবে? আসলে তুমি তো কখনও একা আসোনি তাই জিজ্ঞেস করলাম।" তারপর একটু থেমে বললাম...
- "তা এত সাজগোজ করে চললে কোথায়? কোনো বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছো বুঝি?"
- "সেরকমই বলতে পারো। আসলে কি বলো তো... অনেকদিন টুকাইয়ের সাথে দেখা হবে নাতো, তাই ভাবলাম যাওয়ার আগে একবার দেখা করে যাই। তা, কই সেই রাজকুমার?"
আমার কেন জানি মনে হল, সুলেখাদি কোথায় যাচ্ছে, সেটা আমাকে ঠিক জানাতে চাইল না। তাই এড়িয়ে গেল কথাটা। আমি এবার টুকাইকে ডাক দিতেই যাব, তার আগে দেখলাম সুলেখাদি নিজেই ডাকতে শুরু করল।
- "প্রিন্স... প্রিন্স.. কোথায় তুমি? দেখে যাও তোমার জন্য কতকিছু নিয়ে এসেছি।"
ওহ.. একটা কথা বলতে ভুলে গেছিলাম। সুলেখাদি প্রথমদিন থেকেই টুকাইকে প্রিন্স বলেই ডাকে। নিজের চিপস আন্টির গলার আওয়াজ পাওয়া মাত্রই পাশের ঘর থেকে ছুটে এল টুকাই। তারপর কোনো কথা না বলে একলাফে উঠে বসলো সুলেখাদির কোলে। সুলেখাদিও ওকে আদর করে হামি খেতে খেতে টেবিলের উপর রাখা বড় ব্যাগটার চেন খুলে ফেলল। তারপর, একের পর এক দামি দামি খেলনা, দামি চকোলেট, চিপস... সব বোঝাই করে রাখতে লাগল টেবিলের উপর।
আমি যেন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম!
- "এসব কি সুলেখাদি!!! এত্তো কিছু কেন এনেছ?"
আজ যেন আমারও কিঞ্চিৎ রাগই হল ওর উপর। এসবের মানে কি? কেন এত কিছু এনেছে ও? ও কি তবে এইসব দিয়ে আমার ছেলেটাকে বশ করতে চাইছে? আমি বেশ গম্ভীর গলাতেই বললাম...
- "কিছু মনে কোরোনা সুলেখাদি, এইসব আমি রাখতে পারবো না। ওর বাবা এসে দেখলে খুব রাগারাগি করবে আমার উপর। তুমি এমনিতে রোজ টুকাইয়ের জন্য চকোলেট, চিপস নিয়ে আসো... তা নিয়ে কোনোদিন কিছু বলিনি। কিন্তু তাই বলে এতো কিছু! আমার পক্ষে রাখা সম্ভব হবে না।"
সুলেখাদি এবার সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর দুই হাতে আমার হাত দুটোকে চেপে ধরে বলল...
- "দোহাই সায়নী... আজ তুমি এগুলো ফিরিয়ে দিওনা। আমি বহু আশা করে প্রিন্সের জন্য কিনেছি। দেখ, ও তো আমার সন্তানেরই মত বলো। তাছাড়া মা হয়ে তুমি কি একজন নিঃসন্তান মায়ের যন্ত্রণাটা বুঝতে পারবে না? আজকের পর ছেলেটার সাথে আবার কবে দেখা হবে জানিনা। তাই দয়া করে আমায় নিরাশ কোরোনা। আমি কথা দিচ্ছি তোমায়, আর কোনোদিন এমন ভুল আমি করবো না। শুধু আজকের দিনটা আমায় না বোলোনা। প্লিজ সায়নী... প্লিইইইজ...."
সুলেখাদি শেষের কথাগুলো বলার সময় ওর গলাটা কেমন যেন ভারি হয়ে এল। দেখতে পেলাম ওর চোখের কোনদুটো চিকচিক করছে জলে। কেমন যেন মায়া হল ওর মুখটার দিকে তাকিয়ে। ও তখনও আমার হাতদুটো ধরে, অসহায় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমার উত্তরের অপেক্ষায়। ওকে দেখে আমার বুকটাও কেন জানি ভারি হয়ে এল। চোখদুটো ভেজা ভেজা অনুভব হতে লাগল।
আমিও এবার ওর হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে চেপে ধরে খুব শান্ত গলায় বললাম...
- "ঠিক আছে। থাক এগুলো।"
ও দেখলাম খুশিতে আত্মহারা হয়ে আবার সোফায় বসে কাছে টেনে নিল টুকাইকে।
সেদিন সুলেখাদি প্রায় আধাঘণ্টা মতো ছিল আমাদের ঘরে। তারমধ্যে শুধু এককাপ চা খেয়েছিল, আর সারাক্ষণই টুকাইকে আদর করে গেছিল। এরপর আমায় বলেছিল...
- "আজ তাহলে আমি যাই... যাওয়ার আগে ঘরটা একবার দেখে যেতে হবে।"
আমি বলেছিলাম... "যাই বলতে নেই। বলো আসি।"
তাই শুনে সুলেখাদি আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু একটা হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেছিল ঘর থেকে। আর আমিও দরজা বন্ধ করে রান্নায় আবার মনোযোগ দিয়েছিলাম।
এরপর প্রায় চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট কেটে গেছিল। টুকাই নিজের নতুন খেলনা নিয়ে খেলতে বসেছিল, শাশুড়ি মাও নিজের ঘরে বসে টিভি দেখছিলেন, আর আমি তখন রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম চিকেনটা বানাতে। ঠিক ওইরকম সময় হঠাৎ কেমন যেন একটা বিচ্ছিরি পোড়া পোড়া গন্ধ এসে লাগল আমার নাকে। প্রথমে ভাবলাম চিকেনটা বুঝি কড়াইতে পোড়া লেগে গেছে। তারপর ভাবলাম...
তা কি করে সম্ভব? একমিনিট আগেই তো আমি চিকেনে জল ঢেলে নাড়িয়েছি। তাহলে কোথা থেকে আসছে এই গন্ধ! আমাদের চারতলায় তো আর কোনো লোকও থাকেনা যে তাদের ঘর থেকে আসবে।
আমি বেশ অবাক হয়ে গন্ধের উৎস খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু সারা ঘরে এমন কিছু খুঁজে পেলামনা, যার থেকে ওই পোড়া গন্ধ আসতে পারে। এদিকে প্রতিমুহুর্তে অনুভব করতে লাগলাম গন্ধের তীব্রতা যেন ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছিল। হঠাৎ আমার কানে এল বাইরে কারা যেন খুব চিৎকার চেঁচামেচি করছে। তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখতে পেলাম... ৩০৩ নম্বর রুম অর্থাৎ সুলেখাদিদের দরজার ফাঁক দিয়ে কালো কালো ধোঁয়া বাইরে বেরিয়ে আসছে। আর সেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের বিল্ডিংয়ের দারোয়ান এবং কিছু পুরুষ আর মহিলা চিৎকার করছে, সাথে করে দরজায় ধাক্কাধাক্কি করছে।
কেউ বলছে... "উনি কি বাইরে বেরিয়েছিল?"
দারোয়ান বলছে... "না... শুধু ঢুকতে দেখেছিলাম"
আরেকজন বলছে... "নিশ্চয়ই গায়ে আগুন দিয়েছে, শিগগিরি পুলিশে কল করো"
একজন দেখলাম সাথে সাথে মোবাইলে কাকে যেন কল করে বলছে... "হ্যালো, পুলিশ থানা.... স্যার আমি শান্তিনীড় বিল্ডিং থেকে বলছি... আমাদের এখানে একজন সুইসাইড করেছে।"
টুকরো টুকরো কথাগুলো শুনে মাথার ভিতরটা কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল আমার।
কে গায়ে আগুন দিয়েছে? কে আবার সুইসাইড করলো? এইঘরে তো সুলেখাদি ঢুকেছে, নিজের ঘরটা দেখতে। ওর তো আবার কদিনের জন্য বিয়ে বাড়ি যাওয়ার কথা। তাহলে কে আত্মহত্যা করল?
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ায়, সারা শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠলো আমার! সুলেখাদি বলেছিল...
- "আজকের পর ছেলেটার সাথে আবার কবে দেখা হবে জানি না..."
কিন্তু কেন ও বলেছিল এমন? তবে কি ও এর মানে অন্য কিছু বোঝাতে চেয়েছিল? ও কি তাহলে বলতে চেয়েছিল, আজকের পর আর কোনোদিন টুকাইয়ের সাথে ওর দেখা হবেনা?
তারমানে এই ঘরে এখন যে গায়ে আগুন দিয়েছে, সে হল.......
বুকের ভিতরটা তীব্র গতিতে ধড়াস ধড়াস করতে থাকল আমার।
হঠাৎ সুলেখাদিদের ঘরের ভিতর থেকে একটা বিকট ধরনের 'ফটাস্' শব্দ শোনা গেল। কে যেন একজন বলল...
- "মাটিতে পড়ে মাথার খুলিটা ফেটে গেল হয়তো।"
কথাটা শুনে আমার চোখের সামনে কেমন যেন একটা অন্ধকার ঘনিয়ে এল। আমি ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকে সোফায় বসে পড়লাম।
***************************************
পুলিশ এল পনেরো কুড়ি মিনিট বাদে। ততক্ষনে অরিন্দমও সেলুন থেকে ফিরে এসেছিল। পুলিশের লোকেরা যখন দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকল, তখন ঘরের ভিতর থেকে জমে থাকা চাপ চাপ কালো ধোঁয়া বাইরে বেরিয়ে আসছে। তারসাথে ভেসে আসছে দমবন্ধ করা প্রচণ্ড বিকট মাংস পোড়া গন্ধ। আমি সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখতে পারবো না তাই ঘরেই বসেছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ বাদে অরিন্দম এসে বলল...
- "পাঁচ লিটারের জার ভর্তি করে কেরোসিন তেল এনে রেখেছিল। পুরো শরীরটাই কালো হয়ে প্রায় ছাই হয়ে গেছে। তবে মরার আগে অনেক পাগলামি করেছিল সুলেখাদি। পাশের ঘরে গিয়ে কাঁচী আর রেজার দিয়ে নিজের মাথা ন্যাড়া করেছিল। চুলগুলো সেখানে এখনও আছে। শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ, আর বাকি সব পোশাকও পাওয়া গেছে সেই ঘরে। পুলিশের ধারণা সম্পুর্ণ উলঙ্গ হয়ে, নিজের গায়ে পাঁচ লিটার কেরোসিন ঢেলে তারপর আগুন দিয়েছে।"
আমি তখন আর কিছু শোনা বা বোঝার অবস্থায় ছিলাম না। প্রচণ্ড বিধ্বস্ত লাগছিল নিজেকে। খুব ক্ষীণ কণ্ঠে অরিন্দমকে জিজ্ঞেস করলাম...
- "বডি নিয়ে গেছে পুলিশ?"
ও বলল...
- "সে কি আর নেওয়ার অবস্থায় আছে? কোনোরকমে কাচিয়ে কুচিয়ে যা নেওয়া যায়, তাই নিয়ে গেছে।"
কোনোরকমে উঠে দাঁড়ালাম আমি। তারপর টলতে টলতে আমাদের ঘরের দরজার সামনেটায় এসে দাঁড়ালাম। উল্টোদিকে দেখা যাচ্ছে সুলেখাদিদের দরজাটা খোলা অবস্থায় আছে। তারমানে পুলিশ দরজা ভাঙেনি, লক ভেঙে ভেতরে ঢুকেছে।
আমি দেখতে পারছিলাম একটা পুলিশের লোক একজন সুইপার গোছের ছেলেকে দিয়ে ঘরটা ঝাঁট দেওয়াচ্ছে। আর তাতে ভিতর থেকে একগাদা কুচানো চুল বেরিয়ে এসে বাইরে হাওয়ায় উড়ছে। আমি জানি এগুলো সব সুলেখাদির মাথার চুল। হয়তো জমে থাকা কোনো রাগে, জেদে, অভিমানে নিজের মাথার চুল পাগলের মতো এইভাবে নিজেই কুচিকুচি করেছে। আজ সকালের ওর মুখটা বারবার ভেসে উঠতে লাগল আমার চোখের সামনে। আর মনে হল, বুকের সামনে জমে থাকা দলা পাকানো কান্নাটা এক্ষুনি চিৎকার হয়ে বেরিয়ে আসবে আমার গলা দিয়ে।
নাঃ... আমি আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না সেখানে। চলে এলাম ঘরের ভিতর।
এর পরের দুদিন বেশ ভোগানি গেল আমাদের। পুলিশের লোক এসে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করল আমায়। আমিও যা যা ঘটেছিল, সব সত্যি কথাই বললাম। শুনেছিলাম অতনুদাকেও নাকি জেরা করার জন্য একবেলা আটকে রেখেছিল পুলিশ। অতনুদা স্বীকার করেছিল আগের রাতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেমন ঝগড়া হয়, তাই নাকি হয়েছিল ওদের। তবে ঝগড়ার কারনটা তখনও আমরা কেউ জানতে পারিনি।
যাই হোক, দুদিন পর সবই একটু শান্ত হয়ে এল। পুলিশ ৩০৩ নম্বরের দরজাটা বাইরে থেকে তালা দিয়ে গেছিল আর দারোয়ানকে বলে গেছিল... ওই ঘরে কেউ যেন ঢুকতে না পারে।
এতোদূর অবধি তাও সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু আমাদের অসুবিধাটা শুরু হল তৃতীয় দিন থেকে।
সেদিন অরিন্দম অফিস থেকে ফিরলো রাত সাড়ে আটটা নাগাদ। ফিরেই দেখলাম কেমন যেন থম হয়ে বসে গেল ও। কি হয়েছে কারণ জিজ্ঞেস করাতে ও আমতা আমতা করে বলল...
- "জানো, আজ একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো একটু আগে। আমি যখন লিফটে আসছিলাম, সব ঠিকঠাকই ছিল... কিন্তু তারপর লিফটটা যেই তিনতলা ছাড়লো... শরীরটা নিজের থেকেই কেমন যেন ভারি হয়ে গেল। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আর যখন চারতলাতে নামলাম... মনে হল কেউ যেন পিছন থেকে টেনে ধরে রাখার চেষ্টা করছে। কত কষ্ট করে যে ঘর অবধি এসে বেলটা টিপলাম, আমি নিজেই জানি।"
লক্ষ্য করলাম কোনো এক অজানা কারণে অরিন্দমের দুইহাতের রোমগুলো তখনও খাড়া হয়ে আছে।

© bnbooks.blogspot.com

Bnbooks is one of the largest archieve storage of pdf books, Bengali story, Bangla Kobita, Lyrics and all Kinds of Literature. Tags: Free Bangla pdf books download, Bangla Kobita, Technology News, Song Lyrics.