শফিকের ডাকে আবার চেতনা ফিরে পেলাম।
-রোমেল ভাই, ও রোমেল ভাই।কি হয়েছে,কার সাথে কথা বলেন?
একটু সময় নিয়ে ভেবে উত্তর দিলাম।
-কারোর সাথেই না শফিক। আপনি ঘুমান গিয়ে।
সকালে উঠে শফিকের কাছ থেকে জুয়েলের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে রওনা দিলাম তার বাড়ির উদ্দেশ্যে।
আমার প্রধান লক্ষ্য হয়ে গিয়েছে এই খুনের মোটিভ কি সেটা খুঁজে বের করা।
জুয়েলের বাড়ি যাওয়ার পরে দেখি একটা মধ্যবয়স্ক লোক বাড়ির আঙিনায় কাজ করছে। আমাকে দেখা মাত্রই বললো,
- কাকে চান ভাই?
-আপনি নিশ্চয়ই জুয়েল, তাই না?
- হ্যাঁ, কি দরকার বলুন!
-আসলে আমি একটা এনজিও থেকে এসেছি। আপনার বোনের মৃত্যু সম্পর্কে আমাকে কিছু বলতে পারবেন?
-শুনে লাভ কি?কতজনই তো শুনলো,লাভ কি হলো তাতে?খুনিকে কেউ ধরতে পারলো না!
-আমাকে বলেন, দেখি আমি আপনার বোনের জন্য কিছু করতে পারি কিনা!
জুয়েলের বক্তব্য আমি সম্পূর্ণ তুলে ধরলাম,
''বেশ কিছুদিন ধরেই আমার বোন একটা কথা আমাকে বলছিলো।
-ভাইয়া, কিছু একটা আমাকে রাতে জ্বালায়। ভয় দেখায়,আমি কাউকে দেখতে পাইনা। কিন্তু আমার মনে হয় কেউ একজন আমার শরীরের উপরে ভর করে আছে। প্রচুর ভয় হয় ভাইয়া আমার!
আমি ওকে বারবার অভয় দিই। আমি তো আছি কিচ্ছু হবে না তোর। এর মাঝে আমাদের গ্রামে কিছু অপরিচিত লোকের আনাগোনা দেখতে পাই। একটু তান্ত্রিক টাইপের লোকগুলো। মুক্তার উপর এই অত্যাচারের মাত্রা আরো বেড়ে গেলো।
একদিন সকালে উঠে আমাদের দেখালো তার হাত পায়ে কে যেন আঁচড় কেটেছে।তাকে মারধর পর্যন্ত করা শুরু করে দিয়েছে। এবনরমাল কিছু হচ্ছে মনে করে আমি মাকে বললাম, মুক্তাকে নিয়ে যেন কোনো হুজুরের কাছে যায়।
আমার মায়ের কাছে কে যেন ওই তান্ত্রিকদের কথা বলে। মা সোজা ওদের কাছে চলে যায়। কি সব কথাবার্তা শেষ করে চলে আসে বাড়িতে।
কিন্তু এরপর আরো বেড়ে যায় অত্যাচারের সীমা।মুক্তা রাতে চিৎকার করতে থাকে। ঘুমোতে পারতো না কোনো রাতে। এরপর,
এরপর একদিন সকালে উঠে দেখি মুক্তা ঘরে নেই। সব জায়গায় খুঁজেও যখন মুক্তাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তখন শুনতে পাই শফিকের বাড়ির পিছনে একটা পোড়ালাশ পাওয়া গেছে।
আমরা মুক্তাকে ওর হাত দেখে চিনতে পারি। ওর একটা আঙুল কাটা ছিলো।"
আমি মনোযোগ দিয়ে শোনার পরে জুয়েলকে বললাম,
-জুয়েল ভাই, পুলিশ খুনের কারণ খুঁজে বের করেনি?
- করতে আর পারলো কই? করলে তো আমার বোনের খুনী ধরা পড়তোই।
-জুয়েল ভাই শুনলাম আগেও এরকম কয়েকটা মার্ডার হয়েছে পাশের গ্রাম গুলোতে।আপনি কিছু জানেন?
-শুনেছি। আমি এ ব্যাপারে বিশেষ কিছু বলতে পারবো না।
জুয়েলের থেকে বিদায় নিয়ে আমি রাজবাড়ী থানার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এবার আমার উদ্দেশ্য সফল হলো। আমি তদন্তকারী অফিসার সোহেলকে পেয়ে গেলাম।
- স্যার,আমি একটা কেসের ব্যাপারে আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারি?
-আপনি কে?আর আপনাকে কেসের সম্পর্কে বলবো কেন?
-আমি রোমেল হাসান। ব্যবসা করি কুষ্টিয়ার খোকসায়। লেখাপড়া শেষ করে এসব কেসের বিষয়ে একটু ঘাটাঘাটি করি।আপনি বললে আর কি আমার সুবিধা হয়!
-এসব ছেড়ে দিয়ে কাজে মনোযোগ দেন। ব্যবসা ভালো হবে!
-কেন স্যার, কি সমস্যা?আমাকে একটু হেল্প করেন প্লিজ!
ভদ্রলোক এবার তার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
-এই কেসটা নিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করতে যাইয়েন না। বিপদে পড়বেন!
আমাদের টিমের একজন একটু বেশিদূর চলে গিয়েছিলো কিন্তু তাকে আমরা খুঁজে পাইনি আর।
-মানে, মানে কি এসবের?
-এটা খুন না রোমেল। এটা অন্যকিছুর কাজ!
-মেয়েটার শরীর না আগুনে ঝলসানো ছিলো।তাহলে বুঝলেন কিভাবে, এটা মানুষের কাজ না?
- ফরেন্সিক রিপোর্ট বলে,এই মেয়ের শরীরের মৃত্যুর আগে অনেক নির্যাতন করা হয়েছে। আর সেগুলোর ফলেই মেয়েটার মৃত্যু হয়েছে।তার শরীর থেকে মাংস কেটে আলাদা করে ফেলা হয়েছিলো।
-বলেন কি এসব, এতো কিছু হয়েছে মেয়েটার সাথে?
-হ্যাঁ, অনেক খারাপ হয়েছে!
-কিন্তু হাতের চিহ্নটা?ওটা কি?
-ওটার মর্মার্থ আমরা কেউ বুঝতে পারিনি। আমাদের একজন হারিয়ে যাওয়ার পরে আমরা এই কেসটা নিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করিনি।
আমার মাথায় একটা জিনিস ঘুরপাক খাচ্ছিলো তখন,
একজন পুলিশ আমার মতো সাধারণ মানুষের কাছে একটা কেস সম্পর্কে এতোকিছু বলে দিলো। এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো ভেজাল আছে।
আমি পুলিশকে বিদায় দিয়ে যখন চলে আসতেছিলাম, তখন সোহেল বলে উঠলো।
- ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা। মেয়েটা কিন্তু প্রেগন্যান্ট ছিলো।
আমার মাথার মধ্যে ঘুরে উঠলো। এটা কি ধরণের সারপ্রাইজ ছিলো।
তাহলে কি তার বয়ফ্রেন্ড বা যে এই কাজ করেছে সে তাকে খুন করেছে স্যার?
- হতে পারে, আবার নাও পারে।কারণ মুক্তার ভাই আর মা কাউকে সন্দেহই করতে পারেনি।
******
কেসটাকে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে একটু হাতের কাজ করছিলাম। একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিলাম কেসটার কথা।
একদিন গভীর রাতে আমার ফোনে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ম্যাসেজ আসলো।
-
অমাবস্যায় জাগে সে, নিশিতে করে ভ্রমণ।
যুবতি রাধে নিয়ে তার যত আয়োজন।
এটা কোন ধরণের ম্যাসেজ বুঝে আসলো না।
আমি ম্যাসেজটাকে ইগ্নোর করে ঘুমোতে গেলাম। কিন্তু একটা দুঃস্বপ্নে আমার ঘুম ভেঙে গেলো।
আমি চোখ খুলতেই দেখি একজোড়া নীল চোখ আমার মুখের উপরে ভেসে আছে।
কিন্তু এটা কি?
চোখজোড়া আস্তে আস্তে মুখের উপর থেকে সরে জানালা দিয়ে বাইরে চলে গেল। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে বসলাম। নিজের মনকে এটা বলে স্বান্তনা দিলাম যে,
- দুঃস্বপ্ন দেখেছিস রে। ঘুম থেকে উঠেছিস তাই ভ্রম হয়েছে। ঘুমিয়ে যা।
সে রাতের দুঃস্বপ্ন আমাকে কেসের ব্যাপারে একটা তাগাদা দিলো। যত কাজ ছিলো সব গুছিয়ে রেখে আমি আবারো রাজবাড়ির পথে পা বাড়ালাম।
এবার কারো সাথে দেখা না করে জুয়েলের বাড়িতে চলে আসলাম।
জুয়েলের সাথে দেখাও হয়ে গেলো।
- আসসালামু আলাইকুম জুয়েল ভাই!
- ওয়া আলাইকুম আসসালাম। আপনি আবার?
- ভাই, আমি এই কেসের ব্যাপারে খুব আগ্রহী তো তাই!
- আগ্রহ দেখিয়ে কি লাভ। কতজনই তো আগ্রহ দেখালো। কেউই কিছু করতে পারলো না। আপনিও পারবেন না!
- আমি আশাবাদী ভাই। আমি পারবো।
আগে আমাকে বলেন, আপনার বোনকে আপনার মা যেই তান্ত্রিকের কাছে নিয়ে গিয়েছিলো তার ঠিকানা কোথায়!? আমি তার কাছে যাবো!
- তান্ত্রিকের ঠিকানা! সেটা তো নাই। তারা তো এক জায়গা স্থির না। আমাদের গ্রামে মাস তিনেক ছিলো। তারপরে শুনেছি পাশের গ্রামে গিয়েছে।
- পাশের গ্রাম বলতে কোনটা?
- আপনি এনায়েতপুরের দিকে পাবেন।
- আচ্ছা, আসি!
জুয়েলের থেকে বিদায় নিয়ে এনায়েতপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। শীতের সন্ধ্যা, তারপর মাটির রাস্তা সন্ধ্যা থেকে কুয়াশাচ্ছন্ন। কেমন একটা গা ছমছমে পরিবেশ। আমি আজ একটা বাইক নিয়ে এসেছি। বাইকের আলো জ্বালিয়ে আস্তে আস্তে সেই এনায়েতপুরের উদ্দেশ্যে যাচ্ছি।
মিনিট বিশেক পরে পৌঁছে গেলাম সেখানে। একটা বাজার থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, এনায়েতপুর একটা বিরাট বিল আছে। তার মাঝখানে একটা উঁচু জায়গায় সেই তান্ত্রিক তার দলবল নিয়ে ক্যাম্প করেছে!
হুট করে মাথায় একটা প্রশ্ন এসে পড়লো,
- এই তান্ত্রিক গ্রামে গ্রামে ঘুরে করে কি?
পরক্ষণেই আবার নিজের মাথাকে ঠান্ডা করে নিজেকে বললাম,
- এসব পরে আগে তান্ত্রিকের কাছে যেতে হবে।
তার উদ্দেশ্য কি সেটা পরে শোনা যাবে। আগে মুক্তার কি হয়েছিলো সেটা শুনতে হবে।
এই রাতের বেলা বিলের মাঝখানে কিভাবে যাবো সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পরে গেলাম।
ঠিক তখনি আমাকে আশার আলো জ্বালিয়ে দিলো একদল তরুন ছেলেমেয়ে। যারা রাতের বেলা টর্চ আর বর্শা নিয়ে মাছ ধরতে যাচ্ছিলো।
অবশ্য তবুও দোটানায় পড়ে গেলাম আমার সাথে থাকা মোটরসাইকেল নিয়ে। শেষমেশ একটা দোকানে রেখে ছেলেগুলোর সাথে রওনা দিলাম।
ছেলেগুলোর সাথে আমি হাঁটছি। তারা সবাই আমার সামনে। তারা অতি দ্রুত হাঁটছে। আমি গ্রামের ছেলে, হাটাহাটি দৌঁড়ানো সবকিছু করেই অভ্যাস আছে। কিন্তু এদের সাথে পারতেছি না।
তারা প্রায় দশজনের একটা দল। কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলছে না। যে যার মতো হেঁটে সামনে এগোচ্ছে। হঠাৎ আমার মনে হলো সামনের ছেলেগুলো যেন হাওয়াই মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি আরো জোরে হেঁটে তাদের কাছে যেতে লাগলাম কিন্তু তারা কুয়াশায় মিলিয়ে গেলো।
- এই ভাইয়ারা, শুনছো?
আমি চিনিনা ভাই এই এলাকা! আমাকে নিয়ে যাও সাথে করে!
****
মিনিট বিশেক এদিক ওদিক হাঁটার পরও যখন আমি কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তখন আমার মাথায় আরেক দুশ্চিন্তা দানা বাঁধলো।
এখন তো শীতকাল। গ্রামে, বিলে সব জায়গা পানি শুকানো। তাহলে মাঝ ধরতে এরা কোথায় গেলো?
কিভাবে তারা এতো দ্রুত আমাকে পেছনে ফেলে চলে গেল?
অন্ধকারে যেমন ঢিল ছুঁড়ে তেমনি আমি মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ভয়ে ভয়ে ক্ষেতেই আইল ধরে সামনে যাচ্ছি। যা আছে কপালে।
কিছুদূর যাওয়ার পরে দেখি একটা জায়গায় মনে হচ্ছে আগুন জ্বলছে। আমি যেভাবেই হোক সেখানে পৌঁছানোর চেষ্টা করলাম।
যা ভেবেছিলাম সেটাই সত্য হলো।
পর্ব ৩
এটাই সেই উঁচু জায়গা যেখানে তান্ত্রিক তার আস্তানা গড়ে তুলেছে। আমি কিছুটা সন্তপর্ণে এগিয়ে চললাম। হুট করে সেখানে গেলে হীতে বিপরীত হতে পারে।
সময় নিয়ে সেখানে যাওয়ার সাথে সাথে চারজন লোক এসে আমাকে ঘিরে ফেললো। আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নিয়ে গেলো তান্ত্রিকের কাছে। ভয় পেলেও মনে মনে যা চেয়েছিলাম সেটাই পূর্ণ হলো।
গম্ভীর গলায় আমাকে জিজ্ঞাসা করলো,
- কে তুমি? এখানে কি চাও?
আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আগেই। সেই ভয়ের কারণে একটা জড়তা কাজ করছিলো আমার মধ্যে। আমি সেটাকে কাটিয়ে তুলে বললাম,
- আমি একটা ব্যাপারে আপনার কাছে এসেছি। আমার অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই।
- কি ব্যাপার? বলো!
- আপনারা আগে যে গ্রামে ছিলেন সেখানে একটা খুন হয়েছে কিছুদিন আগে।
- তো, তুমি কি পুলিশের লোক যে আমাদের কাছে এসেছো?
- না আমি পুলিশের লোক না, উৎসাহী হয়ে এসেছি।
- হ্যাঁ, বলো কি জানতে চাও!
- যে মেয়েটা খুন হয়েছে সে খুন হওয়ার আগে আপনার কাছে এসেছিলো। তার মা তাকে নিয়ে এসেছিলো। মনে আছে আপনার?
কিছু সময় ভেবে তান্ত্রিক জবাব দিলো,
- কতজনেই এলো গেলো। কার কথায় মনে থাকে। জগৎ সংসার বড়ই অদ্ভুত।
তুমি কি বলতে চাইতেছো সেটা বলো?
- মেয়েটার কি সমস্যা ছিলো?
- উত্তরের বায়ু যখন দক্ষিণে বয়, তখন কিছু দুষ্টু প্রেতাত্মা ঘোরাঘুরি করে। তাদেরই নজর পড়েছিলো মেয়েটার উপর। তার সাথে সহবাস ও করেছিলো মেয়েটা।
বলেই হাসতে লাগলো খুব বিশ্রী সুরে।
- যেখান থেকে এসেছো সেখানে চলে যাও।
যাও! নিজের ভালো চাইলে চলে যাও!
আমাকে ছেড়ে দেওয়ার সাথে সাথে পুরো তাবুর মধ্যে একবার নজর দিলাম।
মানুষের মাথা, হাড়, কাঁচা মাংস সব দিয়ে তাবু ভরপুর।
কেন জানি আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। আমি মোবাইলে ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে আমার পথে হাঁটা শুরু করলাম।
মনে হতে লাগলো কয়েকজন আমাকে ফলো করছে। কুয়াশার ঘনত্ব এতোই বেশি যে দুই হাত সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে কিনা সেটা বুঝা মুশকিল।
ক্ষেতের ডানপাশ থেকে মিহি সুরে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিলো। কান্নার শব্দ শুনে থমকে দাঁড়ালাম। কান্নার শব্দটা আমার চারপাশ দিয়ে ঘুরতে লাগলো। প্রথমে একজন কান্না করলেও আস্তে আস্তে সেটা কয়েকজনে রূপান্তরিত হলো। আরেকটু সামনে যাওয়ার পরে আমি যা দেখলাম তাতে একটা সুস্থ্য স্বাভাবিক মানুষ দেখে স্থির থাকতে পারবে কিনা সন্দেহ।
একটা ক্ষতবিক্ষত দেহ আমার কয়েক ইঞ্চি সামনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ভয়ংকর এক হাসি দিয়ে গায়েব হয়ে গেলো। আমার গায়ের লোম সব দাঁড়িয়ে গেলো নিমিষেই। আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে দোয়া দরূদ যা পারি তা পড়তে লাগলাম।
'চোখের ভুল আর কানের শোনাতে সমস্যা হচ্ছে' - নিজের মনকে এটা বলেই স্বান্তনা দিলাম।
কিন্তু তাতে লাভ হলো না। কেউ একজন ছোঁ মেরে আমাকে তুলে নিলো শূণ্যে। আমাকে হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে গেলো সামনে। কিছুদূর নিয়ে গিয়ে আমাকে মাটিতে আছড়ে ফেলে দিলো। প্রচন্ড ব্যথায় আমি কাঁতরাতে লাগলাম। পায়ে আর কোমরে মারাত্মক ব্যথা পেয়েছি। তবুও গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে উঠে আমি দৌঁড়াতে লাগলাম। আঁধারে, আন্দাজ করতে পারছিলাম না আমার গন্তব্য কোনদিকে। মিনিট দশেক এভাবে ছুটোছুটি করার পরে একটা জায়গায় গিয়ে আমি উঠলাম। একটা পরিত্যাক্ত বাড়ি সেটা ছিলো যা আমি সহজেই বুঝতে পারলাম।
আমি বাড়িটার একটা কর্ণারে গিয়ে বসে রইলাম। আমার সাথে যা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে আমি সেটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আদৌও কি এগুলো সম্ভব?
হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে রইলাম।
***
''যা করতেছিস সেটা ভালো হচ্ছে না। চলে যা এখান থেকে। মরবি তুই, মরবি। ভালোই ভালোই চলে যা।''
দুঃস্বপ্নে ঘুম ভাঙলো আমার। স্বপ্নে একটা লোক আমাকে বারবার হুমকি দিচ্ছিলো।
ঘুম ভেঙে দেখি সকাল হয়ে গেছে। পাখির ডাক কানে ভেসে আসছে। আমি ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে আমার পথে হাঁটা শুরু করলাম।
গ্রামের মানুষজন তখনো ঘুম থেকে সবাই উঠে নাই। কেউ কেউ অপরিচিত আমাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি এনায়েতপুর বাজারটাতে গিয়ে আমার বাইক নিয়ে আমার পথে যাত্রা শুরু করলাম। রাতে যা হয়েছে তার একটা প্রতিচ্ছবি মনের মধ্যে এঁকে নিতে শুরু করলাম। কিন্তু কিছুতেই কোনো কিছুর সাথে রাতের ঘটনা মেলাতে পারছিলাম না।
সরাসরি আমি বাড়িতে চলে আসলাম। আমার সারাগায়ে কাঁদা মাটি যা আমি খেয়ালই করিনি। আমার মা সেটা দেখে দৌঁড়ে আমার কাছে চলে আসলো। আমি এক্সিডেন্ট করেছি কিনা সেটা বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগলো। আমি মিথ্যা বলেই সে যাত্রায় পার পেয়ে গেলাম।
আমার যেই রুমটাতে আমি রিসার্চ করি সেই রুমে ঢুকে সমস্ত কিছু মেলানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই কোনো ক্লু পাচ্ছিলাম না।
এ যাবতকালে শফিকের গ্রামের আশেপাশে যা মার্ডার হয়েছে তার কিছু তথ্য আমাকে সংগ্রহ করতে হবে।
যেমন- সবাই একই রকমভাবে মারা গিয়েছে কি-না? কারোর শরীরে কোনো অদ্ভুত চিহ্ন ছিলো নাকি? সবাই কি জুয়েলের বোনের মতো প্রেগন্যান্ট?
কিন্তু বাড়ির কাজ, ব্যবসার কাজ ফেলে রেখে এগুলো করলে সবাইকে জবাবদিহি করতে হবে। যা করতে হবে গোপনে!
*****
কয়েকদিন পরে হরিনারায়ণ পুরে একটা মেয়ের ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া গেলো। এটার ভিক্টিমও একটা মেয়ে। মেয়েটার শরীর থেকে হাত বিচ্ছিন্ন ছিলো, কিন্তু সেই হাতে কিছু অদ্ভুত রেখা অঙ্কন ছিলো। ওই এলাকার লোক এবার কিছুটা নড়েচড়ে বসলো। কারণ তারা ততদিনে জেনে গেছে আশেপাশের গ্রামগুলোতেও এমন মার্ডার হয়েছে। তাই তারা আন্দোলন শুরু করে। ফলস্বরূপ পত্রপত্রিকা, টিভি, স্যোশাল মিডিয়া সব জায়গা ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়ে যায়।
ঘটনা আমার চোখ এড়ায় না। ততদিনে আমিও বুঝে গেছি এই কেঁচো খুঁড়তে গেলে অনায়াসে সাপ বেড়িয়ে আসবে। তার আগে আমাকে সব ধরণের ক্লু সংগ্রহ করতে হবে।
সুযোগ বুঝে আমি আবারো রাজবাড়ি চলে গেলাম। শফিক আর জুয়েলকে সর্বোচ্চটা দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করলাম। দেখো,
এইটা কোনো জ্বীন ভুতের কাজ না! এটা পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। আর যদি পরিকল্পিত না হতো তাহলে বেছে বেছে প্রত্যেক গ্রামে একজন করে হত্যা করা হতো না। জ্বীন ভুতের কাজ হলে পুরো গ্রাম সাঁফ করে যেতো।
তারা কিছুক্ষণ ভেবে রাজি হয়ে গেলো আমার সাথে। তাদের দুজনকে বললাম,
- আমাদের আগে সবগুলো মেয়ের বাড়িতে যেতে হবে, যারা আগে মারা গিয়েছে।
শফিক আর জুয়েলের সহায়তায় আমি এক এক করে সবার বাড়ি গেলাম। প্রথম যেই মেয়েটা এমন কিছুর শিকার হয়েছে তার বাড়িতে এখনো শোকের ছায়া।
আমাদের দেখামাত্রই সবাই তাদের রুমের দরজা জানালা আটকিয়ে দিয়ে চলে গেলো। ভেতর থেকে বলে উঠলো,
- এ যাবতকালে বহু সাক্ষাৎকার দিছি সাংবাদিক ভাই। আপনারা যান। আর দেওয়ার ইচ্ছা নাই।
- আপনারা ভুল করছেন। আমরা কেউই সাংবাদিক না। আমার বোনও আপনার মেয়ের মতো ঘটনার শিকার। দয়া করে দরজা খুলুন। কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর নিয়েই চলে যাবো।
একটা পঞ্চাশোর্ধ মহিলা দরজা খুলে বের হয়ে আসলো। চেয়ার বের করে আমাকে বসতে দিয়ে নিজেও বসলো।
কান্না করতে করতে জিজ্ঞাসা করলো,
- কি জানতে চান বলেন?
- যে মারা গিয়েছে সে আপনার কি হয়?
- আমার মেয়ে!
- কতদিন আগে মারা গিয়েছে?
হাতের আঙুল গুনে বললো
- চারমাস সাতদিন।
- কিভাবে কি হয়েছিলো.? বলবেন
- আমার মেয়ে খুব ভালো মেয়ে ছিলো। একদিন হুট করে বমি করতে শুরু করে। আমার কিছুটা সন্দেহ লাগলে আমি ওকে জিজ্ঞাসা করি কোথাও কোনো সম্পর্ক আছে কিনা।
সে আমাকে অবাক হয়ে উত্তর দেয় তেমন কিছুই না মা।
এরমধ্যে কিছু অদ্ভুত আচরণ করতে শুরু করে সে। রাতে ওর রুম থেকে অদ্ভুত হাসির আওয়াজ, মনে হয় যেন কারো সাথে কথা বলছে। আমরা দৌঁড়ে তার রুমে গিয়ে দেখি কেউ নেই। কিন্তু আমরা স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি সে কারো সাথে কথা বলছিলো।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
- সবাই বলে মাথায় সমস্যা হয়েছে। কত ডাক্তার দেখালাম। কিন্তু লাভ হলো না।
মেয়েটাকে আমার কাঁটাছেড়া অবস্থায় পাইলাম।
- আচ্ছা আন্টি, আপনার মেয়ের হাতে কোনোকিছু চিহ্ন ছিলো?
- অত মনে নাই বাবা। তবে ডান হাত কেটে আলাদা করে ফেলেছিলো।
আর হাতের উপর কি যেন আঁকানো ছিলো।
***
আমার সন্দেহই ঠিক। এটা একটা পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। যে হত্যাগুলো করছে সে জেনে বুঝেই করছে।
তার টার্গেট সব উঠতি বয়সের তরুণী। যাদের সে সহজেই কাবু করতে পারে। কারণ উঠতি বয়সের তরুণীগুলো বেশি আবেগপ্রবণ হয়। এদের সহজেই কনভেন্স করা যায়।
কিন্তু তাহলে যে হত্যাকান্ডের শিকার হওয়া মেয়েগুলো অদ্ভুত আচরণ করে আর তাদের রুম থেকে অদ্ভুত শব্দ আসে, এগুলো কে করে?
নিজের মনকে নিজেই প্রশ্ন করলাম!!!
পর্ব ৪ ও শেষ পার্ট
শফিককে সাথে নিয়ে যতগুলো মার্ডার হয়েছে তাদের সবার বাড়িতে গেলাম। তাদের সবার একটা কথা, তাদের মেয়ে/ বোন অদ্ভুত আচরণ করতো।
শফিককে ছেড়ে দিলাম কারণ একদিকে সন্ধ্যা নেমে আসছিলো আর অন্যদিকে বাড়িতে তার মেয়ে একা।
আমার জানামতে এই একটা মাত্র লোক আছে যে এই খুনের প্রায় প্রত্যক্ষদর্শী। কিন্তু এখন তাকে ছেড়ে না দিলে হীতে বিপরীত হতে পারে।
জুয়েলকে সাথে নিয়ে এনায়েতপুরের উদ্দেশ্যে দুজন যাত্রা শুরু করলাম। এর শেষ কোথায় তা দেখতে হবে। সেদিন হঠাৎই আমাদের মোটরসাইকেল এক্সিডেন্ট হয়। মারাত্মক আহত হই দুজন।
**
দরজার কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙে আমার। গ্রামের প্রচলিত একটা রীতি আছে, রাতে একবার ডাক বা শব্দ করলে যেন না ঊঠি।
আমিও শুয়ে আছি। কয়েকবার কড়া নাড়ার শব্দে বিছানায় উঠে বসলাম। এক্সিডেন্টে যে ক্ষত হয়েছে তা এখনো শুকায়নি। পায়ের ব্যথা নিয়েই দরজা খুলতে গেলাম। আমার দেরী দেখে দরজায় কড়া নাড়ার পরিমাণ বেড়ে গেছে।
ভয়ে ভয়ে সামনে এগোচ্ছি। হঠাৎ শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। তবুও আমি দরজা খুলে দেখি কেউ নেই।
দিন পনেরো পরে যখন শরীরটা ভালো হয়ে যায় তখন জুয়েলের সাথে দেখা করতে যাই। তার অবস্থা এখনো খারাপ। হাত ভেঙে গিয়েছিলো এখনো সেটা ঠিক হয়নি।
আমাকে দেখে মৃদু হেসে বললো,
- আগে বলেন তো আপনার বাইক উল্টিয়ে দিলো কে?
আমি মুচকি হাসলাম। উত্তর দিলাম না।
- জুয়েল ভাই, আপনি রেস্ট করেন। আমি আজ যাবো এনায়েতপুর। দেখবো আর জানবো আসলে কাহিনী কি?
শফিক ভাইকে সাথে নিলাম সেদিন। তার মেয়েটাকে একজনের কাছে রেখে দুজন মিলে চলে গেলাম এনায়েতপুর। ওখান থেকে ঠিকানা নিয়ে পাশের গ্রামে যে মার্ডার হয়েছে সেখানে গেলাম।
আমাদের যাওয়া দেখে সবাই কেমন জানি পালিয়ে যেতে লাগলো।মনে হচ্ছিলো আমরা কোনো সন্ত্রাসী। এভাবে কয়েকবার যাওয়ার পরে একজন আমাদের কথার উত্তর দিতে প্রস্তুত হলো।
- ভাই, আমি সবুজ। হাসপাতালে চাকরি করি। একটু মার্ডারটার বিষয়ে শুনতে এসেছিলাম। হাসপাতালে সেদিন বিস্তারিত কিছু শুনতে পাইনি। তাই এসেছি!( মিথ্যা বললাম)
- ও আপনারা হাসপাতাল থেকে আসছেন। আমরা ভাবছি সাংবাদিক। পুলিশ বলেছে সাংবাদিকদের যেন কিছু না বলি। তাই সবাই দূরে সরে যাচ্ছে।
- ওহ আচ্ছা, আসলে কাহিনী কি? মেয়েটা আপনার কি হয়? মারা গেলো কিভাবে?
ছেলেটা মন খারাপ করে বললো,
-মেয়েটা আমার চাচাতো বোন। আমরা পিঠাপিঠি। বেশ কিছুদিন যাবত সে অন্যরকম আচরণ করতো। এই ধরেন রাতে রুম থেকে বের হয়ে এনায়েতপুরের দিকে চলে যায়, তারপর আপনার কেমন জানি শব্দ করে, রুমে কার সাথে যেন কথা বলে।
একদিন দেখে হাত পা উলটে রুমের মধ্যে ভাসছে। আমরা সবাই ভয় পেয়ে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। ডাক্তার বলে রোগী সিজ্রোফেনিয়াতে আক্রান্ত। আমরা ডাক্তারের কথামতো চিকিৎসা করাই। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয় না।
একদিন ওর বমি করা দেখলে সবাই সন্দেহ করে। তারপর ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে রিপোর্ট পায় সে প্রেগন্যান্ট।
এরপর আমরা একদিন তাকে এনায়েতপুরের বিলের মধ্যে পাই। কিন্তু মৃত অবস্থায়। ওর হাত, মাথা সব আলাদা ছিলো শরীর থেকে। শরীরের অর্ধেক পোড়ানো ছিলো। মনে হয় কি আগুন ধরিয়ে দিয়ে কেউ পানি ঢেলে দিছে।
আমি উনার কথা শুনে জাস্ট থ হয়ে রইলাম। এত জায়গা রেখে এনায়েতপুর বিলে কেন?
আমি শফিকের মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
- শফিক ভাই। আসল কালপ্রিট পাওয়া গেছে। তাকে ধরতে কাল সকালে যাবেন না এখন যাবেন?
- এখনই চলেন!
- রাতের বেলা আবার সমস্যা হবে না তো?
- চলেন, কোনো সমস্যা নাই।
শফিককে সাথে নিয়ে দুজন হাঁটা শুরু করলাম এনায়েতপুরের উদ্দেশ্যে। পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় বুঝলাম অনেক খারাপ কিছুই আমাদের সাথে হতে পারে। শফিককে সতর্ক থাকতে বললাম।
দুজনে একমনে হেঁটে যাচ্ছি। মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালানো দুজনেরই। হঠাৎ পাখির পাখা ঝাপটানোর শব্দে দুজন দাঁড়িয়ে পড়লাম। দু চারটা কবুতর ডেকে উঠলো একসাথে। শফিক ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
- ভাই দোয়া ইউনুস পড়েন। বিপদে পড়লে পড়তে হয়।
আমি কোনো কথা না বলে সামনে এগোতে লাগলাম। চাপা কান্নার শব্দ, নাকি সুরে যেভাবে অনেকে কান্না করে সেসব শব্দ ভেসে আসতে লাগলো দূর থেকে।
হঠাৎ আমরা দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়লাম একটা ডাক শুনে,
- আব্বু!
ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখি শফিকের মেয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে আসছে। শফিক বেশ ইমোশনাল হয়ে গেলো। কিন্তু আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম,
- শফিক এখানে আপনার মেয়ে আসবে কিভাবে? যা দেখছেন তা চোখের ভুল। সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটা শুরু করেন।
নানারকম শব্দ আর বাধা অতিক্রম করে দুজন সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। একসময় আমরা দুজনে সেই জায়গাতে গেলাম।
কিভাবে যেন তান্ত্রিক আগেই টের পেয়ে গেছে আমরা সেখানে যাচ্ছি। আমাদের না দেখেই ডাক দিয়ে বললো,
- আসেন আসেন। আপনাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।
আমি বেশ অবাক হয়ে তাকে বললাম,
- এগুলো বন্ধ করেন। আপনার উদ্দেশ্য কি তা আমরা বুঝে গেছি!
তান্ত্রিকের কিছু চ্যালা এসে আমাদের দুজনের হাত বেঁধে ফেললো। অতর্কিত আক্রমণ হওয়ায় কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। হাত বেঁধে দুজনকে গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেললো।
- আমার এই সাধনার জীবনে আপনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি আমাকে ধরে ফেলেছেন। আপনার সাহস আছে।
আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো তান্ত্রিক।
- আপনার উদ্দেশ্য কি আমার জানার দরকার!
- এত শখ কেন মরার?
- মানে?
- মানে আমার ইচ্ছা আছে, কাউকে আমার উদ্দেশ্য বললে আমি তাকে মেরে ফেলবো।
- আচ্ছা, মরার আগে শুনি। কি আপনার উদ্দেশ্য।
- আমি বান্দরবানের একটা গহীন বন থেকে সাধনা করে এসেছি। আমি এমন কিছু জানি যা কেউ জানে না, এমন কিছু পারি যা কেউ পারে না। আমার কথা শোনে কমপক্ষে দশটা জ্বীন। যাদের সাহায্যেই আমি এগুলো করেছি।
তারা সবাই আমার কথায় উঠে আর বসে।
বান্দরবান থেকে সাধনা করে আসার পরে একটা মেয়েকে আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু কোনোভাবেই মেয়েটাকে বশে আনতে পারছিলাম না। তারপর একদিন তাকে জ্বীন দ্বারা বশ করে নিয়ে এসে তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করি।
তাকে দিয়ে এমন সব কাজ করিয়েছি যাতে কেউ টের না পায় এই সব আমিই করাচ্ছি। গ্রামের মানুষ সবাই ভূত প্রেতে বিশ্বাসী। কিন্তু এসবের কলকাঠি যে আমি নাড়াচ্ছিলাম তা কেউ বুঝে উঠতে পারেনি।
এরপর একসময় মেয়েটার উপর থেকে আমার নেশা কেটে যায়। ঘটনা ফাঁস হলে আমার জন্য সমস্যা হতে পারে বিধায় মেয়েটিকে আমি মেরে ফেলি। তার হাতের চিহ্ন একটা সংকেত। যাতে সবাই মনে করে এই কাজ কোনো সাধারণ মানুষে করেছে।
কিন্তু তুই তো জোঁকের মতো লেগে আছিস আমার পিছে। তাই বের করে ফেললি।
.-এরপর বাদবাকি মেয়েগুলো কি অপরাধ করেছিলো?
- যে মেয়েগুলোরে আমার প্রথম দেখায় ভালো লেগেছে আমি তার সাথেই সম্পর্ক করেছি।
বিশ্রী সুরে হাসতে লাগলো তান্ত্রিক।
- তারমানে এই মেয়েগুলোকে আপনি মেরেছেন শুধুমাত্র আপনার খায়েস মেটানোর জন্য?
- অবশ্যই।
- তোদের দুজনকেও তো এখন মেরে ফেলবো শুধুমাত্র মনের খায়েস মেটানোর জন্য!
- মানে?
- কতকিছু করলাম তোরে। ভয় দেখালাম আমার জ্বীনগুলো দিয়ে। এক্সিডেন্ট করলাম। তবুও তুই পিছে গেলি না।কি দিয়ে তৈরি তুই। তোর কলিজা কতবড় সেটা দেখার খুব শখ আমার। তাই তোকে মেরে তোর কলিজা বের করবো।
শফিক ভাই আমতা আমতা করতে করতে বললো,
- আমাদের মেরে আপনার লাভ কি?
বরং মারলে আরো আগে ধরা খাবেন আপনি!
- তোদের বাঁচিয়ে রাখলেও সমস্যা।
কিছু বুঝে উঠার আগে চড়, ঘুষি পড়তে লাগলো আমাদের উপর।
প্রচুর মারতে লাগলো আমাদের দুজনকে।
কিছু সময় পিটানোর পরে তান্ত্রিকের সহযোগীদের মধ্যে একজন বলে উঠলো,
- উস্তাদ এদের ছেড়ে দেন। যে মারা মারছি। যদি কোনোদিন মুখ খোলে তখন একদম খতম করে দেওয়া যাবে।
তাদের মধ্যে কিছুসময় কথা হওয়ার পরে তারা তাদের তল্পিতল্পা গোছাতে লাগলো।
আমাদের বেঁধে রেখেই সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে তারা চলে গেলো।
***
সকাল বেলা আমাদের হাত খুলে দিলো কিছু কৃষক এসে। আমাদের ওই অবস্থায় দেখে তারা এগিয়ে যায়। হাতের বাধন খুলে দিলে আমরা তাদের বলি এই তান্ত্রিকই এই এলাকায় খুন করিয়েছে। কিন্তু কেউই বিশ্বাস করে না।
সেদিনের মতো কাউকে আর কিছু না বলে চলে আসি।
***
সেদিন কাজে খুব ব্যস্ত। হঠাৎ ফোন বাজাতে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে দেখি থানা থেকে ফোন এসেছে।
আমি আগ্রহ নিয়ে কল ধরতেই ওপাশ থেকে বলে,
- আপনি যার নামে অভিযোগ করেছিলেন। তাকে ধরা হয়েছে।
~সমাপ্ত~
© bnbooks.blogspot.com
