''-মেয়েটার পুরো শরীর পোড়ানো ছিল, শুধু তার একটা হাতের কব্জি আলাদা করে কেটে পাশে রেখে দিয়েছিলো। ওই কাটা হাতটুকুর উপরে একটা চিহ্ন আঁকা ছিলো। আপনারা দেখেছেন হয়তোবা!''
এটুকু বলতেই শফিককে থামিয়ে দিয়ে একজন বললো,
-বাহ রে শফিক! ভালোই তো বানিয়ে গল্প বলা শিখে গেছিস। মার্ডার যে তোর ভাতিজা করেছে সেটা সৎ সাহস করে বলে দিলেই তো পারিস। না মেয়েটাকে মার্ডার করে যা লুট করেছিস তার ভাগ দিছে তোরে?
এতক্ষণ আমি একটা খুনের তদন্তে এসে যে আগে লাশ দেখেছে তার বর্ণনা শুনতেছিলাম। মাঝখানে এই লোকটা এসে বাগড়া দিল।
আমি উনার কথায় পাত্তা না দিয়ে তাকে থামিয়ে বললাম,
-শফিককে বলতে দিন! চুপ সবাই কেউ কোনো কথা বলবেন না!
হ্যাঁ , শফিক ভাই আপনি বলেন! এরপর কি দেখেছেন?
-সেদিন রাতে আমরা বাবা মেয়ে কেউই ঘুমোতে পারি নাই। এই দৃশ্য দেখার পরে কেউ ঘুমোতে পারে, বলেন?
-আমি না বোধক সম্মতি দিয়ে মাথা ঝাঁকালাম।আসলেই কেউ এমন ভয়ংকর লাশ দেখে ঘুমোতে পারবে কিনা সন্দিহান।
- হ্যাঁ, তারপর?
- তারপর আমি মেয়েটাকে নিয়ে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করি। এরকম ভয়ংকর লাশ আমি বাপের জন্মেও দেখিনাই। কিন্তু এই মেয়েটাকে কে মেরে আমার ঘরের পিছে রেখে গেছে আমি সত্যিই জানিনা।
আমি রোমেল হাসান। পড়াশোনা শেষ করে ব্যবসা করি আর সাইকোলজি নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করি। পাশের জেলায় এমন মার্ডার হয়েছে শুনে তদন্ত করতে এসে এমন লোমহর্ষক বর্ণনা শুনতেছি। এর আগেও অনেক খুনের ঘটনা শুনেছি কিন্তু এমন গা হিম করা ঘটনা শুনিনি।
-আচ্ছা, শফিক ভাই আমাকে আরেকটা কথা বলতে পারবেন?
- সবই তো বললাম।আর কি বলবো?আমার এসব কথার জবাব দিতে দিতে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে!
-বলতেছি, এইরকম মার্ডার কি এই এলাকায় প্রথম?
-না,,, এর আগেও এমন তিন চারটা খুন হয়েছে।তবে আমি গ্রামে আসার আগে। কেন আপনি জানেন না?
আমি শফিক সাহেবকে একটা এনজিওর কর্মী বলে পরিচয় দিয়েছি। তাই হয়তোবা ভাবছে আমি সব জানি!
- না ভাই,আমি সম্প্রতি এখানে জয়েন করেছি।আপনি বললে ভালো হয়!
- ওহ, লাশের হাতে কেমন চিহ্ন ছিল দেখবেন না?
শফিক নিজেই আগ্রহের সহিত কথাটা বলে তার মেয়েকে খাতা কলম আনতে বললো!
- শফিক ভাই!
-হু!
- মেয়েটা কে ছিলো ভাই?
-জুয়েলের বোন। বয়স ১৯ বছর হয়েছিলো।
আমার মাথায় তখন নানা প্রশ্ন ঘুরতে লাগলো। এটা কি ধর্ষণ মামলা না অন্যকিছু?
আমাকে আগে এর আগের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার আদ্যোপান্ত খুঁজে বের করতে হবে!
শফিক তার মেয়ের এনে দেওয়া খাতায় চিহ্নটা এঁকে দেখালো। কিছুটা ট্রায়েঙ্গেল টাইপের কিন্তু মাঝখানে একটা ডিফারেন্ট টাইপের সাইন।
-শফিক ভাই,মাঝখানের ওটা কি?
-আমার যতদূর মনে পড়ে লাইটের আলোতে আর সকালে যা দেখেছিলাম তাতে ওটা ইংরেজি 'W' টাইপের ছিলো।
আমার আর মনে পড়ছে না।
অনেকক্ষণ বাদে ওই লোকটা বলে উঠলো,
-তোরে যে পুলিশ এই খুনের সাথে জড়িতে থাকার জন্য পিটালো সেটা বলিস না কেন উনারে?
বলে দে!
শফিক লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেললো। আমি বুঝলাম এই লোকটা কিছুই জানেনা, শফিককে বাঁশ দেওয়ায় তার কাজ।
সেদিনের মতো শফিকের বাসা থেকে চলে আসলাম। কিন্তু আমার লাইফে এমন কেস আগে একটাও পাইনি। যেখানে কোনো ভিক্টিমের পুরো শরীর পুড়িয়ে শুধু হাত কেটে কোনো সাইন রেখে গেছে। এরকম কাজ তো সিরিয়াল কিলাররা করে।তারমানে এটা কি কোনো সিরিয়াল কিলারের কাজ? না কেউ মেয়েটার উপর তার প্রতিশোধ নিছে?
হত্যার পুরো কাহিনী আমাকে থানা থেকে শুনতে হবে! তাই চলে গেলাম রাজবাড়ী থানাতে।
কিন্তু এই কেসের তদন্ত কর্মকর্তাকে না পেয়ে সেদিনের মতো চলে আসলাম। আমি আবারো শফিকের বাসায় গেলাম। তখন সন্ধ্যা ৬ টা মতো বাজে।আমি শফিককে বললাম,
-শফিক ভাই।আরেকটু হেল্প করেন না! আমি ওই লাশ যেখানে ছিলো সেখানে একটু ঘুরে দেখতে চাই! আমাকে নিয়ে চলেন তো!
-এখন তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে।তারপর আজ আবার অমাবস্যা। ওদিকে তো জঙ্গল আমার মনে হয় আজ না যাওয়ায় বেটার হবে।আপনি বরং অন্য একদিন এসে দেখে যাইয়েন?
-আরে, কিসব অমাবস্যা বিশ্বাস করেন মিয়া। আসেন, যাই!
শফিক তার মেয়েকে ভাত রান্নার দায়িত্ব দিয়ে আমার সাথে তার বাড়ির পেছনের জঙ্গলে চললো।
ততক্ষণে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে চারিদিক। মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে যা দেখা যায় তাই দেখতে দেখতে এগিয়ে চলছি।
আমাকে থামিয়ে দিয়ে শফিক বললো,
-থামেন! ওইখানে মনে হচ্ছে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে।
আমি মোবাইলে ফ্ল্যাশ উঁচিয়ে ধরলাম।
-নাহ,কেউ নেই শফিক ভাই!চলেন
এবার একটা চাপা কান্নার আওয়াজ আসতে লাগলো আমাদের পেছন থেকে!
-অদ্ভুত শফিক ভাই, আপনাদের বাসায় তো আপনার মেয়ে ছাড়া কেউ নেই!কান্না করে কে তাহলে?
শফিক আমাকে কিছু না বলে তার মেয়ের নাম ধরে ডাক দিয়ে দৌঁড়ে চলে গেলো।আমি একা তখন জংগলের মধ্যে দাঁড়িয়ে। একটা গা ঠান্ডা করা বাতাস শরীরের উপর দিয়ে বয়ে গেলো।
শফিক আমাকে বলেছিলো আরেকটু সামনেই লাশটা পাওয়া গিয়েছিলো। তাই আমি আরেকটু সামনে গিয়ে একটা জায়গা দেখতে পেলাম। আশপাশ থেকে পরিষ্কার জায়গাটা। একটা মানুষের আকৃতির মতো জায়গাটা।
আমি ওখানে হাঁটু গেড়ে বসে দেখতে লাগলাম জায়গাটা। হঠাৎ কেউ একজন আমার পিঠের উপর হাত রাখলো।
আমি বললাম,
-শফিক ভাই আসছেন?
বলেই পেছনে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই আমার পিছে। তাহলে হাত রাখলো কে?
আমি তখন স্পষ্ট হাত রাখার অনুভূতি পাচ্ছিলাম। ভালো করে খেয়াল করে দেখি একটা কাঁটা হাত আমার কাঁধের উপর।
আমি চিৎকার করে উঠলাম।
ওখান থেকে দৌঁড়ে আসার মতো সাহস আমার হচ্ছিলো না। আমি শুধু দৌঁড় দিলাম।কিন্তু অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেললাম।কারণ আমার মোবাইল ওখানেই পড়ে গেছে।
নাটকীয় এই ঘটনায় আমি পুরোটা অবাক হয়ে গিয়েছি। এরকম ঘটনা অবশ্য এবারই প্রথম নয়।
কিন্তু তাই বলে এটা কি হলো?- নিজেকে প্রশ্ন করতে করতে লাইটারের আগুন জ্বালিয়ে ধরে রাখলাম।
-একটা মিহি কান্নার আওয়াজ আসতে লাগলো। নাকি সুরে কান্নার আওয়াজটা যে কারো কানে বেঁধে যাবে অনায়াসে। কিন্তু কে কান্না করছে? কেন কান্না করছে জানিনা!
আমি একটু ধমকের সুরেই বলে উঠলাম,
-এই, কে ওখানে?কে? আমাকে ভয় দেখানো হচ্ছে? তাইনা?
আমি এসবে ভয় পাইনা, সাহস থাকলে সামনে এসে এসব করো!
আমার কথার জেরেই কিনা জানিনা,
নাটকীয়ভাবে একটা লাশ উপর থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় আমার সামনে নামতে লাগলো। লাইটারের আলোতে যা বোঝা যাচ্ছিলো, তাতে লাশটা অর্ধগলিত,পঁচা, দুর্গন্ধময়। উলটো হয়েই আমার সামনে একটা বিদঘুটে হাসি দিলো।
আমি ধপাস করে বসে পড়লাম। তারপর কি হলো জানিনা।
আমার ঘুম ভাঙলো শফিকের হাতের পানি ছিটানোর মাধ্যমে।প্রচন্ড শীতের মধ্যে এরকম ঠান্ডা পানি মুখের উপরে পড়লে মৃত মানুষও জ্যান্ত হয়ে যাবে, আর এ তো আমি!
আমার চোখ খোলার সাথে সাথে শফিক বললো,
-কতবার করে আপনারে বললাম আজ অমাবস্যা! ওদিকে যাইয়েন না। তারপরেও শুনলেন না, বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়েছে তো?
-কি যে বলেন শফিক,,সারাদিন এদিক ওদিক করেছি তো। তাই মে বি হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। আপনি বেশিই বিশ্বাস করছেন ওইগুলো!
- আমিও একটা শিক্ষিত ছেলে। আমি আগে এসব ভুত-প্রেত,আত্মা ফাত্মায় বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু ভূত প্রেত না থাকলেও জ্বীন তো আছে। শয়তান, ওগুলো বড় শয়তান।
-এই যে নেন,আপনার মোবাইল। আর এখানে রাত থেকে সকালে চলে যান।বেশি ঘাটাঘাটি করার দরকার নাই। আগের পুলিশও কিন্তু অনেক ঘাটাঘাটি করছে এসব নিয়ে। কিন্তু বেশি কিছু করতে পারে নাই। তারচেয়ে বরং আপনিও কেটে পড়েন। উপকার হবে।
-কিন্তু, শফিক আগে যে আরো চারটা খুন হয়েছে এগুলোর কিছু কি জানেন?
মানে কারা কারা এই ভিক্টিম?
-আমি কিছু জানিনা, আপনারও জানার দরকার নেই। ভালোই ভালোই কেটে পড়ুন।
তবে শুনেছি, ওই মেয়েগুলোকেও এভাবে পুড়িয়ে মারা হয়েছে।
আমাদের দুজনের কথার মাঝখানে ছেদ পড়লো একটা চাপা আর্তচিৎকারে।
চিৎকারটা ঠিক বাড়ির পেছন সাইড থেকে আসছিলো।
শব্দের গতিবেগ বুঝে শফিক আমাকে বললো,
''কোনো শব্দ করবেন না। এইরকম চাপা চিৎকার আমি বহুবার শুনেছি। শব্দ করলে চিৎকারটা রুমের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে।"
আমি শফিকের কথা শুনে বাধ্যছেলের মতো ঘরের এককোণে চুপ করে বসে থাকলাম। জীবনে প্রথমবার এমন অভিজ্ঞতা ভালোই লাগছিলো। প্রচুর ভয় পেয়েও গিয়েছি এই রকম দেখে।
সে রাতে শফিকের বাড়িতে আমার শোবার ব্যবস্থা করা হলো। টিনশেড বাড়ির দুইটা রুম। একটাতে মেয়ে আর শফিক,আরেকটা আমার থাকার ব্যবস্থা করা হলো।
রাতে ঘুম ভাঙলো ঠান্ডা কিছুর স্পর্শে। শীতের রাত হওয়ার কম্বল গায়ে ছিলো। কিন্তু হঠাৎ শরীরের উপর ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেয়ে আমার ঘুম হাওয়া হয়ে গেলো। চোখ খুলতেই যা দেখলাম সেটা দেখার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না।
আমার শরীরের উপরে একটা অদ্ভুত দেখতে প্রাণি শুয়ে আছে। শুয়ে আছে বললে ভুল হবে সে আমার গলাটাকে আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছে। কিন্তু মনে হচ্ছে কেউ একজন তাকে আটকে ধরে আছে যার কারণে সে আমার গলা ধরতে পারছে না।
আমি চিৎকার করে ঊঠলাম কিন্তু আমার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না।
চলবে…………………
© bnbooks.blogspot.com
